বাতায়ন24
মুসলিম জগতের উজ্জল নক্ষত্র তথা প্রথম ইসলাম গ্রহনকারী ও ইসলামি খেলাফতের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক (রাঃ) এর জীবনী।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর বংশধারা ও উপাধি :
আবু বকরের পূর্ণ নাম আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে আমির ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তায়িম ইবনে মুররাহ ইবনে কাব ইবনে লুয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর আল কুরাইশি।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে আবু বকরের বংশলতিকা পেছনের দিকে অষ্টম পর্যায়ে একইরূপ। মুররাহ ইবনে কাব তাদের উভয়ের পূর্বপুরুষ। মুহাম্মদ (সাঃ) এর পূর্বপুরুষের ধারা হল মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররাহ।
কুরআনে আবু বকরকে গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। হিজরতের সময় মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেয়ার কারণে এভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। আবু বকর মিরাজের ঘটনা শোনা মাত্র বিশ্বাস করেছিলেন বলে তাকে মুহাম্মদ (সাঃ) সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইমাম জাফর আল-সাদিক ছিলেন মায়ের দিক থেকে আবু বকরের বংশধর। পিতার দিক থেকে তিনি ছিলেন আলি ইবনে আবি তালিবের বংশধর ।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর অসংখ্য হাদিস আবু বকরের মেয়ে ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী আয়িশা(রা.) মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। নারীদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে অধিক হাদিস বর্ণনাকারী। আবু বকরের মৃত্যুর পর তার সন্তান মুহাম্মদ ইবনে আবি বকরকে আলি ইবনে আবি তালিব লালনপালন করেছেন।
উমাইয়াদের হাতে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর নিহত হওয়ার পর আয়িশা তার ভাইপো কাসিম ইবনে মুহাম্মদকে শিক্ষা দেন ও লালনপালন করেন। এছাড়া আয়িশা তার আরেক ভাইপো উরওয়াহ ইবনে জুবায়েরকে শিক্ষাপ্রদান করেছেন যিনি তার সন্তান হিশাম ইবনে উরওয়াহকে শিক্ষা দেন। হিশাম ইবনে উরওয়াহ ছিলেন ইমাম মালিক ইবনে আনাসের প্রধান শিক্ষক।
কাসিমের মা ছিলেন আলির পরিবারের সদস্য। তার কন্যা ফারওয়াহ বিনতে কাসিমের সাথে মুহাম্মদ আল বাকিরের বিয়ে হয়। তাদের সন্তান ছিলেন ইমাম জাফর আল-সাদিক। এদিক থেকে কাসিম প্রথম খলিফা আবু বকরের নাতি এবং জাফর আল সাদিকের দাদা।
আবু বকরের আরেকজন নাতি আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের মুহাম্মদ (সাঃ) এর নাতি হুসাইন ইবনে আলির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হুসাইন নিহত হওয়ার পর তিনি উমাইয়াদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান।পরবর্তীতে আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের উমাইয়া বাহিনীর হাতে নিহত হন।
হযরত আবু বক্কর (রাঃ) এর প্রথম জীবন :
আবু বকর ৫৭৩ সালের দিকে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছেন।তার বাবার নাম আবু কুহাফা ও মায়ের নাম সালমা বিনতে সাখার।
অন্যান্য আরব শিশুদের মতো আবু বকর তার বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি তার বাবার সাথে একটি বাণিজ্য কাফেলায় করে সিরিয়া যান। পরে তিনি বাণিজ্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তিনি সিরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি স্থানে সফর করেছেন। এসব সফরের ফলে তিনি ধনী ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়ে উঠেন। তার পিতা বেঁচে থাকলেও আবু বকর গোত্রের প্রধান হিসেবে সম্মান পেতে থাকেন।
আবু বকর শিক্ষিত ছিলেন এবং কাব্যের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। তার স্মৃতিশক্তি ভালো ছিল এবং আরব গোত্রসমূহের বংশলতিকা নিয়ে পাণ্ডিত্য ছিল।
হযরত আবু বকর এর ইসলাম গ্রহণ:
আবু বকর প্রথম যুগের ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তিনি প্রথম ইসলামগ্রহণ করেছিলেন। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, অন্যান্য সবার ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাদের মনে কিছু মাত্রায় দ্বিধা ছিল; কিন্তু আবু বকর বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর জীবন:
আবু বকরের স্ত্রী কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা ইসলাম গ্রহণ করেননি। আবু বকর তাকে তালাক দিয়েছিলেন। তার অন্য স্ত্রী উম্ম রুমান ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ছেলে আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর ছাড়া অন্য সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ফলে আবু বকরের সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে। আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর পরবর্তীকালে মুসলিম হয়েছিলেন।
আবু বকরের ইসলাম গ্রহণ অনেককে ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহ যোগান। তার দ্বারা উৎসাহিত হয়ে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
আবু বকরের অনুপ্রেরণায় ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছেন:
* উসমান ইবনে আফফান (পরবর্তীতে তৃতীয় খলিফা)
* জুবাইর ইবনুল আওয়াম
* তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ
* আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাশিদুন খিলাফতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন)
* সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (মুসলিমদের পারস্য বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন)
* আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (সিরিয়ায় রাশিদুন সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন।)
* আবু সালামা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদ
* খালিদ ইবনে সাইদ
* আবু হুজাইফা ইবনে আল মুগিরা
আবু বকরের ইসলাম গ্রহণ সুদূরপ্রসারী ফলাফল এনেছিল। মক্কায় এসময় দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। দাসদের মধ্যে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে। স্বাধীন ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণের পর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে থাকে তবে তারা তাদের নিজ গোত্রের নিরাপত্তা ভোগ করত। কিন্তু দাসদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না এবং তারা নির্যাতনের সম্মুখীন হয়। আবু বকর দাসদের প্রতি সদয় হয়ে অনেককে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন। আবু বকরের মুক্ত করা দাসরা অধিকাংশ নারী, বৃদ্ধ বা দুর্বল ব্যক্তি ছিল।
তার মুক্ত করা দাসদের মধ্যে রয়েছেন :
*বিল্লাল ইবনে রাবাহ
* আবু ফাকিহ
* আম্মার ইবনে ইয়াসির
* আবু ফুহাইরা
* লুবাইনা
* আন নাহদিয়া
* উম্মে উবাইস
* হারিসা বিনতে আল মুয়াম্মিল
কুরাইশদের নির্যাতন:
ইসলাম প্রচারের প্রথম তিন বছর মুসলিমরা তাদের বিশ্বাস প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেনি। এরপর আল্লাহর তরফ থেকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ আসলে তিনি তাতে অগ্রসর হন। এরপর মুসলিমদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আবু বকরও নিগ্রহের স্বীকার হয়েছিলেন।
মক্কায় শেষ বছরসমূহ :
৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশদের পক্ষ থেকে বনু হাশিম গোত্রকে একঘরে করে রাখা হয়। ফলে তারা মক্কার সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এর পূর্বে কিছু মুসলিম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন।
৬২০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিব মারা যান। এরপর সংঘটিত হওয়া মিরাজের ঘটনা আবু বকর বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করেছিলেন যার কারণে তাকে সিদ্দিক উপাধি দেওয়া হয়।
মদিনায় হিজরত :
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করতে শুরু করে। কয়েকটি দলে এই হিজরত হয়। মুহাম্মদ (সাঃ) ও আবু বকর একই সাথে হিজরত করেন। মুহাম্মদ (সাঃ) তার কাছে গচ্ছিত মক্কাবাসীর সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আলি ইবনে আবি তালিবকে দায়িত্ব দিয়ে যান।
হামলার আশঙ্কায় তারা মদিনামুখী উত্তরের পথ না ধরে দক্ষিণমুখী ইয়েমেনগামী পথ ধরে অগ্রসর হন এবং পাঁচ মাইল দূরে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন। আবু বকরের ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে আবি বকর এসময় তাদের সাথে রাতে থাকতেন এবং ভোরের পূর্বে মক্কায় ফিরে আসতেন যাতে অন্যদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি না হয়।
এছাড়াও আবু বকরের এক দাস আমির বিন ফুহাইরাহ পর্বত পর্যন্ত ছাগল চরাতেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকরের চলাচলের চিহ্ন মুছে যায়। এছাড়াও তিনি তাদের ছাগলের দুধ পান করাতেন। আবু বকরের মেয়ে আসমা বিনতে আবি বকর তাদের খাবার নেয়ার কাজ করতেন।

হিজরতের সংবাদ জানতে পেরে তাদের ধরার জন্য মক্কা থেকে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন দিকে পাঠানো হয়। অণুসন্ধানকারীরা গুহা পর্যন্ত পৌছে গেলে আবু বকর চিন্তিত হয়ে উঠেন। মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে অভয় দিয়ে বলেন,
এরূপ দু’জন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ।
এ বিষয়ে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে…
যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, (তবে স্মরণ কর) আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন অবিশ্বাসীরা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সে ছিল দুজনের একজন। যখন তারা গুহার মধ্যে ছিল, সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিল, মন খারাপ করো না, আল্লাহ তো আমাদের সাথেই আছেন। তারপর আল্লাহ তার উপর প্রশান্তি বর্ষণ করলেন।….সূরা তওবা, আয়াত ৪০
এই আয়াতে দু’জনের একজন দ্বারা আবু বকরকে বোঝানো হয়েছে।
গুহায় তিনদিন ও তিনরাত অতিবাহিত করার পর তারা দুজন মদিনার দিকে অগ্রসর হন। তারা মদিনার শহরতলী কুবায় পৌঁছে সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এরপর তারা মদিনায় পৌঁছান।
মদিনার জীবন :
মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এরপর মসজিদে নববী নির্মাণ করা হয়। আবু বকর এর নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) অন্যান্য সাহাবিদের ন্যায় আবু বকরের সাথে খারিজাহ বিন জাইদ আনসারিকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন।
খারিজাহ বিন জাইদ মদিনার শহরতলী সুনহে থাকতেন। আবু বকরও সেখানে বসতি স্থাপন করেন। আবু বকরের পরিবার মদিনায় চলে আসার পর তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিকটে একটি বাড়ি কিনেন।
মক্কার তুলনায় মদিনার জলবায়ু ছিল আর্দ্র। ফলে মুহাজির মুসলিমদের অনেকে নতুন পরিবেশে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবু বকরও অসুস্থতায় আক্রান্ত হন এবং বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। এসময় খারিজা ও তার পরিবার তার সেবা করে। মক্কায় আবু বকর একজন কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি মদিনায়ও একই ব্যবসা শুরু করেন। মদিনায় দ্রুত তার ব্যবসা সমৃদ্ধি লাভ করে।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর অধীনে সামরিক অভিযান :
বদরের যুদ্ধ এবং উহুদের যুদ্ধ
৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে আবু বকর মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর তাবুর প্রহরার দায়িত্বে ছিলেন। পরের বছর উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছেন।
ইহুদি গোত্রের সাথে সংঘর্ষ
বনু নাদির অভিযান, বনু কুরাইজা অভিযান এবং খায়বারের যুদ্ধ
পরে আবু বকর ইহুদি বনু নাদির গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছেন।
খন্দকের যুদ্ধ
৬২৭ সালে তিনি খন্দকের যুদ্ধ এবং পরবর্তী বনু কুরাইজা অভিযানে অংশ নিয়েছেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ (সাঃ) সৈনিকদের বেশ কয়েকটি দলে ভাগ করে একেক অংশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে একটি আবু বকরের তত্ত্বাবধানে ছিল।
শত্রুরা নানাভাবে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করলেও আবু বকর তার দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশে আক্রমণ ঠেকিয়ে দেন। তার নামে সে অংশে একটি মসজিদ নির্মিত হয় যা মসজিদ-ই-সিদ্দিকী বলে পরিচিতি লাভ করে।
৬২৮ সালে তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এই সন্ধির অন্যতম সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন। তিনি খায়বারের যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন।
মক্কা বিজয় :
৬৩০ সালে আবু বকর মক্কা বিজয়ে অংশ নিয়েছেন। এর পূর্বে তার বাবা উসমান আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
হুনায়ন ও তাইফের যুদ্ধ :
৬৩০ সালে তিনি হুনায়নের যুদ্ধ এবং তাইফ অবরোধে অংশ নেন। হুনায়নের যুদ্ধের সময় মুসলিম সেনাবাহিনী হুনায়ন উপত্যকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের তীরের সম্মুখীন হয়। অপ্রস্তুত অবস্থায় হামলা হওয়ায় মুসলিমদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। অনেকে ছুটোছুটি শুরু করলেও কয়েকজন সাহাবি মুহাম্মদ (সাঃ) কে রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। আবু বকর তন্মধ্যে অন্যতম।
তাবুক অভিযান :
৬৩০ সালে তাবুক অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। এতে সহায়তার জন্য মুহাম্মদ (সাঃ) মুসলিমদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়াতে বলেন। উসমান ইবনে আফফান এতে প্রায় নয়শ উট এবং একশ ঘোড়া পর্যন্ত দান করেন।উমর ইবনুল খাত্তাব তার সম্পদের অর্ধেক দান করেন। আবু বকর তার সকল সম্পদ দান করে এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার বক্তব্য ছিল, আমি আল্লাহ ও তার রাসূলকে আমার ও আমার পরিবারের জন্য রেখেছি। এই ঘটনা আল্লামা ইকবালের একটি কবিতার পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
আমিরুল হজ্জ হিসেবে আবু বকর :
৬৩১ সালে মুসলিমদের একটি দল জাহিলিয়াতের চর্চা মুক্তভাবে হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করে। আবু বকর এই দলের নেতৃত্ব দেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি প্রথম আমিরুল হজ্জ বা হজ্জের নেতা হিসেবে স্বীকৃত।
আবু বকর ও হাজিদের দলটি হজ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হবার পর হজ্জ এবং অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়।
তা জানানোর জন্য আলিকে প্রেরণ করা হয়। আবু বকর তার কাছে জানতে চান যে তিনি নেতৃত্ব দিতে এসেছেন নাকি নির্দেশ নিয়ে এসেছেন। আলি জানান যে তিনি নির্দেশ নিয়ে এসেছেন।

মক্কায় হজ্জের পর ১০ জিলহজ তারিখে কুরবানির দিন হজ্জের জন্য কংকর নিক্ষেপের স্থান জামারায় আলি নতুন নির্দেশ ঘোষণা করেন। এতে বলা হয়,
এরপর থেকে অমুসলিমরা হজ্জের জন্য কাবায় আসতে পারবে না।
কেউ নগ্নভাবে কাবা তাওয়াফ করতে পারবে না।
মুশরিকদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিসমূহ বিলুপ্ত করা হয় এবং এসকল বিষয় নিষ্পত্তি করার জন্য চার মাস সময় দেওয়া হয়।
চুক্তির আওতা বহির্ভূতদের ক্ষেত্রেও চারমাসের সময়ের কথা বলা হয়। তবে যদি মুশরিকরা মুসলিমদের সাথে চুক্তি সম্পাদনে ত্রুটি না করে বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে কারো সাহায্য না করে তবে তাদের অঙ্গীরকারনামা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়।
আবু বকর সিদ্দিকের অভিযান :
আবু বকর একটি সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন যা আবু বকর সিদ্দিকের অভিযান বলে পরিচিত। নজদে এই অভিযান সংঘটিত হয়।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর ইন্তেকাল :
বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার কিছুকাল পর মুহাম্মদ (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন,এবং অসুস্থতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় তিনি তার মৃত্যুর চারদিন আগ পর্যন্ত নামাজের ইমামতি করেছেন। এরপর অসুস্থতার মাত্রার কারণে ইমামতি করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি এসময় আবু বকরকে নামাজের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যু সংবাদ প্রচার হওয়ার পর উমর ইবনুল খাত্তাব অশান্ত হয়ে পড়েন এবং তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন যে যেভাবে মুসা (আঃ) তুর পাহাড়ে চল্লিশ দিন ছিলেন তেমনি মুহাম্মদ (সাঃ) ফিরে আসবেন। এসময় আবু বকর তার সুনহের বাড়ি থেকে এসে আয়িশার ঘরে প্রবেশ করেন। এখানে মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যু হয়েছিল।
তিনি বলেন,
আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার উপর দুইবার মৃত্যু একত্রিত করবেন না, এ মৃত্যু আপনার ভাগ্যলিপিতে ছিল সেটা এসে গেছে।
এরপর তিনি বাইরে এসে ঘোষণা করেন,
তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুসরণ করতে তারা জেনে রাখুক যে মুহাম্মদ (সাঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে, অবশ্যই আল্লাহ সর্বদাই জীবিত থাকবেন কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।
আবু বকর কুরআন থেকে তিলাওয়াত করেন :
এবং মুহাম্মদ (সাঃ) তো একজন রাসুল। তার পূর্বে অনেক রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি ইন্তেকাল করেন কিংবা শহীদ হন তবে কি তোমরা উল্টো পায়ে ফিরে যাবে ? এবং যে উল্টো পায়ে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এবং অনতিবিলম্ভে আল্লাহ কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কার দেবেন।.. সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৪৪
আবু বকরের বক্তব্যের পর উমরের অবস্থা শান্ত হয়।
খলিফা নির্বাচন :
মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। মুহাজির ও আনসাররা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচনের পক্ষে ছিল। কিছু গোত্র পুরনো প্রথা অনুযায়ী গোত্রভিত্তিক নেতৃত্ব ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়।
আনসাররা সাকিফা নামক স্থানে একত্রিত হয়ে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। এরপর আবু বকর, উমর ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এখানে আসেন। সভার আলোচনায় এক পর্যায়ে উমর ইবনুল খাত্তাব আবু বকরের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহও তার অণুসরণ করেন। এরপর বাকিরাও আবু বকরকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়। সুন্নিরা তাকে খলিফাতুর রাসূল বা আল্লাহর রাসূলের উত্তরাধিকারী বলে সম্মান করে থাকে। তবে শিয়ারা আবু বকরকে বৈধ খলিফা বলে স্বীকার করে না। শিয়া মতাদর্শ অনুযায়ী আলি ইবনে আবি তালিব প্রথম খলিফা হিসেবে যোগ্য।
শাসনকাল :
আবু বকরের খিলাফত ২৭ মাস অর্থাৎ দুই বছরের কিছু বেশি সময় স্থায়ী ছিল। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাকে বেশ কিছু অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হতে হয় এবং তিনি তা সফলভাবে মোকাবেলা করেন। নতুন নবী দাবিকারী বিদ্রোহীদেরকে তিনি রিদ্দার যুদ্ধে দমন করেছেন।
তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে উমর ইবনুল খাত্তাব এবং উসমান ইবনে আফফান এই অভিযান অব্যাহত রেখেছিলেন। এসব অভিযানের ফলে মুসলিম সাম্রাজ্য কয়েক দশকের মধ্যে শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়। খলিফা হওয়ার পর তিনি অন্যান্যদের পরামর্শক্রমে তার কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে দেন এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা গ্রহণ করতেন।
রিদ্দার যুদ্ধ :
আবু বকরের খিলাফত লাভের পর বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে রাষ্ট্রের কাঠামোর উপর আঘাত আসে। বেশ কিছু আরব গোত্র বিদ্রোহ করে এবং কয়েকজন ব্যক্তি নবুওয়ত দাবি করে। তাদের মধ্যে মুসায়লিমা ছিল অন্যতম প্রধান।
বিভিন্ন গোত্রের তরফ থেকে বক্তব্য আসে যে তারা শুধু মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি অনুগত ছিল এবং তার মৃত্যুর পর মিত্রতা শেষ হয়েছে। প্রাচীন আরবে এই ধরনের প্রথা প্রচলিত ছিল যার আওতায় গোত্রের নেতার মৃত্যুর পর মিত্রতা সমাপ্ত হত।
এছাড়াও বিদ্রোহ গোত্রগুলো জাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আবু বকর তাদের দাবি অস্বীকার করেন এবং বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হন।
এসকল ঘটনা ফলে রিদ্দার যুদ্ধের সূচনা হয়। মধ্য আরবে মুসায়লিমা ইয়ামামা থেকে ধর্মদ্রোহিতার নেতৃত্ব দেয়। বিদ্রোহের অন্যান্য কেন্দ্রসমূহ দক্ষিণ ও পূর্বে বাহরাইন, ওমান, মাহরা, ইয়েমেনে অবস্থিত ছিল।
আবু বকর তার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে মুসলিম সেনাবাহিনীকে ১১টি দলে গঠন করেন। সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাদলের নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ।
শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে লড়াইয়ের জন্য তাদের ব্যবহার করা হত। তুলনামূলক কম শক্তিশালীদের সাথে লড়াইয়ে অন্য সেনাদলগুলোকে নিয়োজিত করা হত। আবু বকর প্রথমে পশ্চিম ও মধ্য আরবের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, এরপর মালিক ইবনে নুয়াইরাকে মোকাবেলা করা এবং চূড়ান্ত ভাবে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ মুসায়লিমার মুখোমুখি হওয়ার পরিকল্পনা করেন।
বেশ কিছু সফল ও ধারাবাহিক অভিযানের পর শেষপর্যন্ত খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসায়লিমাকে ইয়ামামার যুদ্ধে পরাজিত করতে সক্ষম হন। শেষপর্যন্ত সকল বিদ্রোহীকে দমন করা হলে আরব পুনরায় খিলাফতের আওতায় ঐক্যবদ্ধ হয়।
৬৩২ সালের জুলাই মাসে আবু বকর মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিজ গোত্র বনু হাশিমের সদস্যদের নিয়ে একটি সেনাদল গঠন করেন।

আলি ইবনে আবি তালিব, তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ ও জুবায়ের ইবনুল আওয়াম প্রত্যেকে সেনাদলের এক তৃতীয়াংশের নেতৃত্ব লাভ করেন।
তারা জু কিসার যুদ্ধে স্বঘোষিত নবী তুলায়হার সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তুলায়হা ও তার অণুসারীরা রিদ্দার যুদ্ধের সময় মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। এই যুদ্ধে তুলায়হাকে পরাজিত করা হয়।
কুরআন সংকলন :
আবু বকর সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে কুরআন সংকলন করেন। ইতিপূর্বে কুরআনের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্নভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। এছাড়াও হাফেজরা কুরআন মুখস্থ করে রাখতেন। ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফেজ শহিদ হলে উমর ইবনুল খাত্তাব গ্রন্থাকারে কুরআন সংকলনের জন্য আবেদন জানান।
এই প্রথা মুহাম্মদ (সাঃ) এর সময় ছিল না বলে প্রথমে আবু বকর এতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু উমর তাকে রাজি করাতে সক্ষম হন। এজন্য জায়েদ ইবনে সাবিতকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এর সদস্যরা সবাই হাফেজ ছিলেন। তারা কুরআনের সকল অংশ সংগ্রহ করে একক গ্রন্থ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন এবং হাফেজদের স্মৃতির সাথে সেগুলো মিলিয়ে দেখা হয়।
মৃত্যুর আগে আবু বকর কুরআনের এই কপিটি তার উত্তরসূরি উমর ইবনুল খাত্তাবকে দিয়ে যান। উমরের শাসনকালে এটি তার কাছেই রক্ষিত ছিল। উমর কুরআনটি তার মেয়ে ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী হাফসা বিনতে উমরকে দিয়ে যান। পরবর্তী খলিফা উসমান ইবনে আফফান এই কুরআনের আরো প্রতিলিপি তৈরি করিয়ে তা খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেছিলেন।
সামরিক সম্প্রসারণ :
রিদ্দার যুদ্ধে বিদ্রোহ দমন করার পর আবু বকর বিজয় অভিযান শুরু করেন। এসময় বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। এসকল অভিযান সফল হয়েছিল।
পরবর্তী খলিফারাও এই অভিযান চালু রাখেন। অভিযানের ধারাবাহিকতায় কয়েক দশকে মুসলিম সাম্রাজ্যে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের অন্যতম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ইরাকের মাধ্যমে অভিযান শুরু করা হয়েছিল। এটি ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ। আবু বকর সবচেয়ে দক্ষ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদকে সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন।
সাসানীয় সাম্রাজ্য জয় :
উত্তর-পূর্ব দিকে পারস্য সাম্রাজ্য এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করা হয়েছিল। এসকল অভিযানের তিনটি উদ্দেশ্য ছিল বলে গণ্য করা হয় :
১. আরব এবং এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে বেশ কিছু আরব যাযাবর গোত্রের বসবাস ছিল যারা এই দুই সাম্রাজ্যের মিত্র হিসেবে কাজ করত। আবু বকরের আশা ছিল যে তারা ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাদের আরব ভাইদের সাথে একতাবদ্ধ হবে।
২. পারস্য ও রোমানদের কর ব্যবস্থা ছিল অন্যায্য প্রকৃতির। তাই এসকল অঞ্চলের বাসিন্দারা মুসলিমদের অধীনে থাকতে পছন্দ করবে বলে বিশ্বাস করা হত।
৩. দুইটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে থাকার ফলে আরব নিরাপদ ছিল না। তাই ইরাক ও সিরিয়া আক্রমণ করে সীমান্ত অঞ্চল থেকে প্রতিপক্ষ হটিয়ে দেওয়ার জন্য আবু বকর অগ্রসর হন।উত্তর পূর্ব আরবের একজন গোত্রপ্রধান মুসান্না ইবনে হারিসা ইরাকের পারস্য শহরগুলোতে আক্রমণ করেন। এসকল অভিযান সফল হয় এবং এ থেকে অনেক যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্জিত হয়।
মুসান্না ইবনে হারিসা মদিনা গিয়ে খলিফা আবু বকরকে তার সাফল্যের ব্যাপারে জানান। তাকে তার লোকেদের নেতা নিয়োগ দেওয়া হয়।
এরপর তিনি ইরাকের আরো ভেতরে প্রবেশ করেন। তার হালকা অশ্বারোহী বাহিনীর দ্রুত চলাচলের সুযোগ নিয়ে তিনি মরুভূমির নিকটবর্তী যে-কোনো শহরে আক্রমণ করে দ্রুত মরুভূমিতে আত্মগোপনে চলে যেতে পারতেন। সাসানীয় বাহিনীর পক্ষে তার পিছু নেওয়া সম্ভব ছিল না। মুসান্নার কার্যক্রম আবু বকরকে সীমানা সম্প্রসারণে প্রভাবিত করে।
আবু বকর ইরাকের মাধ্যমে অভিযান শুরু করেন। সাসানীয়রা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হওয়ায় এসকল অভিযানে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
সাফল্যের জন্য আবু বকর দুইটি পদক্ষেপ নেন, প্রথমত, স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন, দ্বিতীয়ত, তার সেরা সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদকে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। ইয়ামামার যুদ্ধে মুসায়লিমাকে পরাজিত করার পর খালিদ ইয়ামামায় থাকাবস্থায় তাকে সাসানীয় সাম্রাজ্যে অভিযানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাকে আল হিরা অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আবু বকর তাকে অতিরিক্ত সৈন্য দিয়ে সাহায্য প্রেরণ করেন। উত্তরপূর্ব আরবের গোত্রপ্রধান মুসান্না ইবনে হারিসা, মাজহুর বিন আদি, হারমালা ও সুলমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে তারা তাদের লোকজনসহ খালিদের অধীনে কাজ করেন।
৬৩৩ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে (১২ হিজরির মুহররমের প্রথম সপ্তাহ) খালিদ ইয়ামামা থেকে ১০,০০০ সেনা নিয়ে অগ্রসর হন।গোত্রপ্রধানরা প্রত্যেকে ২,০০০ সৈনিক নিয়ে খালিদের সাথে যোগ দেন। এভাবে খালিদ তার ১৮,০০০ সেনা নিয়ে পারস্য সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেন।
ইরাকে প্রবেশের পর খালিদ পরপর চারটি যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। এগুলো হল শিকলের যুদ্ধ, নদীর যুদ্ধ, ওয়ালাজার যুদ্ধ ও উলাইসের যুদ্ধ।
৬৩৩ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে এই যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়। এসময় পারস্য সাম্রাজ্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সমস্যাগ্রস্ত ছিল।
৬৩৩ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ইরাকের রাজধানী আল হিরা মুসলিমদের পদানত হয়। কিছু সময় বিরতির পর জুন মাসে খালিদ আনবারের উপর অবরোধ আরোপ করেন।
প্রথমে প্রতিরোধ এলেও পরে জুলাই মাসে তারা আত্মসমর্পণ করে।এরপর খালিদ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে জুলাই মাসে আইনুল তামিরের যুদ্ধে শহর জয় করেন। ইতিমধ্য প্রায় সমগ্র ইরাক মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে এসে পড়ে। এসময় উত্তর আরব থেকে আরেক মুসলিম সেনাপতি আয়াজ বিন গানাম সাহায্য চান।
তার দল বিদ্রোহী কিছু গোত্রের ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল। খালিদ দাউমাতুল জান্দালের দিকে অগ্রসর হন এবং আগস্টের শেষ সপ্তাহে দাউমাতুল জান্দালের যুদ্ধে বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন। আরব থেকে ফিরে এসে তিনি বৃহৎ আকারের একটি পারস্য বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবর পান।

তাদের সাথে কিছু আরব মিত্রও ছিল। খালিদ তাদের পরাজিত করার জন্য দক্ষভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তিনি তার পুরো বাহিনীকে তিনটি দলে বিভক্ত করেন এবং রাতের বেলা তিনটি ভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এসময় মুজিয়ার যুদ্ধ, সান্নির যুদ্ধ এবং জুমাইলের যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা হয়। এসকল যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ইরাকে পারস্য সাম্রাজ্যে কর্তৃত্বের অবসান হয়।
পারসিয়ান রাজধানী তিসফুন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে ছিল। রাজধানী আক্রমণের পূর্বে খালিদ দক্ষিণ ও পশ্চিমের সকল পারসিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি সীমান্তবর্তী ফিরাজ শহরের দিকে অগ্রসর হন এবং ৬৩৩ সালের ডিসেম্বরে সাসানীয়, বাইজেন্টাইন ও খ্রিষ্টান আরবদের সম্মিলিত বাহিনীকে ফিরাজের যুদ্ধে পরাজিত করেন। ইরাক অভিযানের এটি ছিল শেষ যুদ্ধ। তিসফুনের পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ কাদিসিয়া আক্রমণের জন্য অগ্রসর হওয়ার সময় তার কাছে আবু বকরের নির্দেশ এসে পৌঁছায় যাতে তাকে সিরিয়ান ফ্রন্টে মুসলিম সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নিতে আদেশ দেওয়া হয়।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে অভিযান :
সাসানীয় সাম্রাজ্যে সফল অভিযানের ফলে খালিদের উপর আবু বকরের আস্থা বৃদ্ধি পায়। তিনি চারটি বৃহৎ সেনাদল জু কিসায় গ্রহণ করেন এবং তাদের রোমান সিরিয়ায় প্রেরণ করেন। প্রত্যেক সেনাদলের আলাদা কমান্ডার ও লক্ষ্যবস্তু ছিল। কমান্ডাররা গোয়েন্দা মারফত জানতে পারেন যে আজনাদায়নে একটি বড় আকারের বাইজেন্টাইন সেনাদল অগ্রসর হচ্ছে।
তাই সেনাপতিরা অগ্রসর না হয়ে আবু বকরের কাছে অতিরিক্ত সাহায্য চেয়ে পাঠান। এসময় ইরাকে মুসলিমদের অবস্থা সবল হওয়ায় আবু বকর খালিদকে নির্দেশ দেন যাতে তিনি তার ইরাকের বাহিনীর অর্ধেক নিয়ে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। খালিদকে সিরিয়ায় মুসলিম সেনাবাহিনীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তৎকালীন বাইজেন্টাইন প্রদেশ সিরিয়া বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান, ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি অঞ্চল, লেবানন ও দক্ষিণ তুরস্ক নিয়ে গঠিত ছিল। ইরাক থেকে সিরিয়ার দিকে যাওয়ার দুইটি পথ ছিল। একটি ছিল দাউমাতুল জান্দালের মধ্য দিয়ে আরেকটি রাকার মধ্য দিয়ে।
খালিদ অধিক প্রচলিত দাউমাতুল জান্দালের পথ ত্যাগ করেন। এই পথ ছিল দীর্ঘ এবং এতে সিরিয়া পৌঁছাতে সপ্তাহ লেগে যেত। তিনি রাকার মেসোপটেমিয়ান পথও এড়িয়ে যান কারণ বাইজেন্টাইন গেরিসন উত্তর সিরিয়া ও উত্তর মেসোপটেমিয়ার অংশ ছিল। তাদের মুখোমুখি হলে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় বেশি প্রয়োজন হত। এসবের পরিবর্তে খালিদ সিরিয়ান মরুভূমির মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত ও অপ্রচলিত পথের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। এভাবে খালিদ উত্তর সিরিয়ায় প্রবেশ করেন। তিনি বাইজেন্টাইনদেরকে ডানদিক থেকে আক্রমণ করেন। তার অতর্কিত আক্রমণ বাইজেন্টাইনদের উপর প্রভাব ফেলেছিল।
খালিদ ৬৩৪ সালের জুনে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন এবং দ্রুত সীমান্তবর্তী সাওয়া, আরাক, তাদমুর, সুখনা, কারইয়াতাইন ও হাওয়ারিন দুর্গ দখল করেন। এরপর তিনি দামেস্কের দিকে অগ্রসর হন। এরপর তিনি বুসরা দিকে যান। এই ছিল গাসানীয় আরব রাজ্যে রাজধানী।
তারা বাইজেন্টাইনদের মিত্রপক্ষ ছিল। তিনি অন্যান্য মুসলিম সেনাপতিদের নির্দেশ দেন যাতে তারা বাহিনী নিয়ে বুসরায় জড়ো হয়। মারাজ আল রাহাবে খালিদ গাসানীয় সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। ইতিমধ্যে সিরিয়ায় মুসলিম সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ আরেক সেনাপতি শুরাহবিল ইবনে হাসানাকে বুসরা আক্রমণের আদেশ দেন। শুরাহবিল তার ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে বুসরা অবরোধ করেন।
বাইজেন্টাইন ও তাদের আরব মিত্ররা এই বাহিনীকে কোনো বড় মুসলিম বাহিনীর অগ্রবর্তী দল ভেবে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা দুর্গ নগর থেকে বেরিয়ে এসে শুরাহবিলের বাহিনীকে আক্রমণ করে। খালিদ সেখানে পৌঁছে তাদের সাথে যোগ দেন।
খালিদ, শুরাহবিল ও আবু উবাইদার সম্মিলিত বাহিনী এরপর বুসরার যুদ্ধে যোগ দেয়। এর ফলে গাসানীয় রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে।
এখানে খালিদ খলিফার নির্দেশ মোতাবেক আবু উবাইদার কাছ থেকে মুসলিম সেনাবাহিনীর দায়িত্বগ্রহণ করেন। বড় আকারের একটি বাইজেন্টাইন সেনাদল আজনাদায়নে জমায়েত হওয়া শুরু করে। খালিদের নির্দেশ অনুযায়ী মুসলিম বাহিনী আজনাদায়নে জমায়েত হয়। এখানে সংঘটিত আজনাদায়নের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদের পরাজয়ের ফলে সিরিয়া মুসলিমদের হাতে পতিত হয়।
খালিদ বাইজেন্টাইনদের শক্ত ঘাঁটি দামেস্ক জয়ের সিদ্ধান্ত নেন। খালিদ দামেস্কে পৌঁছে শহর অবরোধ করেন। বাকি অঞ্চল থেকে শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য দক্ষিণে ফিলিস্তিনের পথে, উত্তরে দামেস্ক-এমেসার পথে এবং অন্যান্য কিছু স্থানে সেনা মোতায়েন করেন।
শেষপর্যন্ত ৩০ দিনের অবরোধের পর খালিদ দামেস্ক জয় করতে সক্ষম হন। দামেস্কের পতনের সংবাদ পাওয়ার পর হেরাক্লিয়াস এমেসা থেকে এন্টিওকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বার্ষিক করের বিনিময়ে নাগরিকদের শান্তিতে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়। দূরে চলে যাওয়ার জন্য বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয় তিন দিনের সুযোগ।
এই সময়সীমা শেষ হওয়ার পর খালিদের নেতৃত্বে দামেস্কের ১৯০ মাইল উত্তরে বাইজেন্টাইনদের সাথে মারজ আল দিবাজের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবু বকর মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি হিসেবে উমর ইবনুল খাত্তাব খলিফা হন। তিনি খালিদকে পদচ্যুত করে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহকে সিরিয়ার মুসলিম সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্য :
৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বিছানায় শায়িতাবস্থায় থাকেন। আবু বকর তার উত্তরসূরি মনোনীত করার জন্য প্রয়োজনীয়তা অণুভব করেন যাতে তার মৃত্যুর পর মুসলিমদের মধ্যে সমস্যা দেখা না দেয়। অন্যান্য সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে তিনি উমর ইবনুল খাত্তাবকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন।
৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট আবু বকর মারা যান। আয়িশার ঘরে মুহাম্মদ (সাঃ) এর পাশে তাকে দাফন করা হয়।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর পরিবার:
বাবা : উসমান আবু কুহাফা
মা : সালমা উম্মুল খাইর
ভাই : মুতাক, উতাইক ও কুহাফা ইবনে উসমান
বোন : ফাদরা ও কারিবা
বোন : উম্মে আমির
স্ত্রী : প্রথম উম্মে রুমান ও দ্বিতীয় জন কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা (দ্বিতীয় জন তালাকপ্রাপ্ত)
মেয়ে : আসমা বিনতে আবি বকর
নাতি :আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের, আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান, আবু আতিক মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান, উরওয়া ইবনুল জুবায়ের
নাতনি হাফসা বিনতে আবদুর রহমান
ছেলে : আবদুল্লাহ ইবনে আবি বকর
সৎ ছেলে : তুফায়েল ইবনে আবদুল্লাহ (আবদুল্লাহ ইবনে হারিসের ছেলে)
ছেলে : আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর
মেয়ে : আয়িশা
স্ত্রী : আসমা বিনতে উমাইস
ছেলে : মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর
নাতি : কাসিম ইবনে মুহাম্মদ
স্ত্রী : হাবিবা বিনতে খারিজা
মেয়ে : উম্মে কুলসুম বিনতে আবি বকর
সুপ্রিয়,পাঠক আমরা আন্তরিক ভাবে সচেষ্ট বিশ্বের জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মনিষীদের মহান শিক্ষনীয় জীবনী অনলাইন ভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকা বাতায়ন24 এর মাধ্যমে তুলে ধরতে।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলের কাজকে কবূল করুন।