নীল আজ কোথায়? অন্তরার মনে এই প্রশ্ন বার বার নাড়া দিচ্ছে। সেদিনের সেই চলার পথগুলো অন্তরা এখনো ভুলতে পারেনি। কেন অন্তরা সেদিন নীলকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল? আজকের এই অনুশোচনা যদি সেই দিনে থাকতো তাহলে আজ, “নীল আকাশে থাকতো অন্তরার বসবাস। মায়া দিয়ে সমৃদ্ধ হতো দুটি মন”।
– সবকিছু আজ ওলটপালট হয়ে গেছে। বাড়ির ছাদে বসে আনমনা হয়ে অন্তরা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে, “যদি তোমার অন্তরে অন্তরে ক্ষয়ে যেতে হয়, আমি বিলীন হয়ে যেতে চাই তোমার সঙ্গে”।
অন্তরা ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান। বাবা কোর্টের উকিল, মা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বাড়িতে তাদের তিনটি পেট। অন্তরার বাবা সোমেশ গাঙ্গুলি ও মা মালবিকা গাঙ্গুলি মেয়েকে নিয়ে অনেক বড়ো স্বপ্ন দেখে। এবারে তাদের স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে অন্তরা। এদিকে কৃষক পরিবারের সন্তান নীল তাদের স্কুলে প্রথম স্থান লাভ করেছে। নীলের বাবা একজন ভাগচাষী। মা বাড়িতে কাজ সামলায়। নীলদের সংসার খুব কষ্টে চলে। নীলের বাবা বলে, “আমার যতো কষ্ট হোক বাবা, তোকে তোর লক্ষ ঠিক রাখতে হবে, পয়সার অভাবে এক সময় আমার বাবা পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল, আমি চাইনা সেই রকম ঘটনা আমার ছেলের জীবনে আসুক কখনো।”
– সেদিন নীল বাবার এই কথায়, নীরব থেকে ছিল। সে জানে তার বাবা কত কষ্ট করে এই সংসার চালাচ্ছে। এদিকে অন্তরা মাঝে মাঝে নীলদের বাড়িতে আসে। কিন্তু অন্তরা কখন যে নীলকে ভালোবেসে ফেলেছে সে মুখ ফুটে কখনো বলতে পারেনি নীলকে। প্রতিবারে আসে,নীলের সঙ্গে দেখা করে, আর কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায়। এতোদিনে অন্তরার মনের কথা নীল ও বুঝে উঠতে পারেনি। তারা সবে একই কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে। আলাপ চারিতা তাদের মধ্যে সবসময় হতো। অন্তরা বার বার নীলের কাছে ছুটে আসতো, কিন্তু কখনো তার মনের কথা সে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। একদিন নীল অন্তরার সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল।সেদিন নীল অন্তরার কথা গুলো গভীর ভাবে শুনছিল হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই, “দুজনের মুখের ভাষা জড়তায় পরিণত হলো”!
– নীল বুঝতে পেরেছিল অন্তরার মনের কথা। কিন্তু নীল ভাবতো অন্তরার পরিবার নিয়ে,”যেখানে ওই নীল আকাশে চাঁদ কত যত্নে লালিত-পালিত কিন্তু আমার স্বপ্নের মাটিতে কাদাবালি মিশ্রিত আছে”।
– এই দ্বিধা বার বার নীলকে ঘিরে ধরতো। তাই সে একটু এড়িয়ে চলতো অন্তরাকে। একদিন অন্তরা হঠাৎ নীলকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে গেলো একটা নির্জন জায়গায়। সেখানে দুজনে কিছুক্ষণ নীরব, “দু’জনের মুখের ভাষায় একটা অস্পষ্টতা বসে গেছে বার বার কিন্তু কিন্তু শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে”!
– তাদের এই ভালোবাসার মাঝে অন্তরার বাবা যে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে অন্তরা কখনো ভাবতে পারেনি। কারন অন্তরা তার বাবার থেকে আজ পর্যন্ত যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। অন্তরার বাবা সোমেশ গাঙ্গুলি সব জানতে পেরে, একদিন হঠাৎ নীলদের বাড়িতে এসে নীলের বাবাকে সকল গ্রামবাসীর সামনে তীব্র ভৎসনা করে অপমান করেছিল,”একটা ভাগচাষী, ওর কি যোগ্যতা আছে আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ায়? ভবিষ্যতে আর কখনো আমার মেয়ের সঙ্গে দেখতে পেলে এই গ্রাম থেকে ভিটে ছাড়া করবো”।
– সেদিন নীল বাড়িতে ছিল না। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে বাবার থেকে সব কথা শুনে মাথা গরম করে ফেলেছিল নীল। তার বাবাকে অপমান করা তার হৃদয়ে ভীষণ আঘাত সৃষ্টি করেছিল। নীল অন্তরার বাড়িতে যেতেই অন্তরার বাবা বলে, “এই চাষীর ছেলের সাহজ কি করে হয় আমার বাড়িতে পা রাখে”?
– সেদিন নীল নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি বাবার অপমানের কথা মনে করে। বলে আপনি যাদের চাষি বলছেন এই চাষীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে বলেই আপনাদের মতো বড়ো মানুষের “পেটে খাদ্য জোটে”। আমরা চাষী হতে পারি কিন্তু আমাদের ও সম্মান আছে। সেদিন অন্তরার বাবা চাকরকে ডেকে বললো, “এই ছোটোলোকের বাচ্চাটাকে এখান থেকে বের করে দাও”!
– সেদিন নীল যেই অন্তরার বাবার দিকে ছুটে যাচ্ছি,অন্তরা নীলের হাতটা ধরে ফেলে। অন্তরা বলে, “তোমার এতো বড়ো সাহজ, আমার বাবার দিকে হাত তুলতে আসো, বেরিয়ে যাও আমাদের বাড়ি থেকে।”
– সেদিন নীল শুধু অন্তরাকে একটা কথা বলেছিল, “আমরা ছোটোলোক নয়, আমাদের ও শরীরে রক্ত মাংস আছে”। সেদিন নীল মাথা নিচু করে চলে এসেছিল।
সেই নীল এখন কোথায়? হয়তো কোন গ্রামের অলি-গলিতে ঘুরছে বেকার হয়ে। সেদিনের সেই অপমান নীল ভুলতে পারেনি। তাই পড়াশোনা বন্ধ করে, একটা মোটর মেকানিক দোকানে কাজ শেখে। তাকে এখন অনেক টাকা রোজগার করতে হবে। বাবার জন্য সুন্দর একটা পোশাক ও মায়ের জন্য শাড়ি কিনে দিতে হবে সামনে দুর্গা পূজো এবং বাড়ির চালটা সারাই করতে হবে। আর অন্তরার জন্য…? এই কথা মনে এলে, নীল মাঝে মাঝে অন্যমস্ক হয়ে কিছু ভাবে। বাড়িতে তেমন ফেরে না নীল। সারাদিন মোটর মেকানিক দোকানে কাজ করে চলেছে। সেদিনের পর থেকে অন্তরার বাবা মেয়েকে বাইরের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দিয়ে আসে। এই সামনের দুর্গা পূজোতে অন্তরা প্রায় দুই বছর পর বাড়ি ফিরে,গ্রামের দূর্গা পূজো দেখবে এবং নীলের বাড়িতে যাবে কতদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি,”অবেলা দুপুরে বসে অন্তরা নীলকে নিয়ে ভাবে, মনে মনে বলে সেদিনের অপমান আমি করতে চাইনি”!
– সেদিন অন্তরা গাড়ি করে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল। রাস্তার বাঁক ঘুরতে হঠাৎ নীলকে দেখতে পেলো, “সেদিন অন্তরা এই দৃশ্য দেখে নীরব থেকে ছিল। যে একদিন ছিল ক্লাসের ফাষ্ট বয়, আজ তার জীবন মোটর মেকানিক দোকানে লোহা ঠুকতে ঠুকতে জীবন কাটছে”।
– পাল্টে গেছে নীল। অভাব তাকে বদলে দিয়েছে, গাল ভর্তি দাড়ি, মাথার চুল উস্কো-খুস্কো। সেদিন অন্তরা আনমনা হয়ে বাড়ি ফিরেছিল।পরদিন সকালে লুকিয়ে অন্তরা নীলদের বাড়িতে যায়। সেদিন নীলের বাড়ি ফিরতে প্রায় দুপুর একটা বেজেছিল। নীল পুকুরে হাত পা ধুঁয়ে মা’কে বললো, “মা খাবার দাও, অনেক কাজ পড়ে আছে এখনো”।
– বাড়িতে ডুকে সামনে অন্তরাকে দেখে নীল বিস্মিত হয়েছিল। নীল নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অন্তরা বললো, “কি অবস্থা করেছো নিজের?”
– নীলের দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। অবাক হয়ে অন্তরা ও কাঁদতে শুরু করে দিল, “আমি সেদিন অপমান করতে চাইনি, বাবা সেদিন এতোটাই রেগেছিল, আমি তোমাকে ওখান থেকে সরাতে চেয়েছিলাম, তাই বাধ্য হয়ে ওই কথাগুলো বলেছি।”
– সেদিন নীলের বাবা ও মা অন্তরাকে পেয়ে ভীষণ খুশি। অন্তরা বললো,মা ও বাবাকে আমি বুঝিয়ে বলেছি, বাবা সেদিনের অপমানের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত। অন্তরা নীলকে বললো,”আর কাজ করতে হবে না, বাবাকে বলেছি তোমাকে একটা ব্যবসায় যুক্ত করে দেবে”!
– সেদিন নীল, অন্তরার এই কথাতে ভীষণ আনন্দিত। নীল বললো, “দু’জনের জন্য ভাত বাড়ো মা”
– অন্তরা নীলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অন্তরা বললো, “তাহলে শেষ পর্যন্ত নীলের আকাশে অন্তরা ধরা দিলো”।
– নীলের ঠোঁটের কোনে একটু হাসির ফোয়ারা খেলে গেলো।আবার হয়তো জোয়ার-ভাটার স্রোতে নীল ও আন্তরা সমৃদ্ধ হবে “কোন একটা সুখের পরশ পাথরের ছোঁয়াতে।