শাশ্বত মন্ডল
(ভারত)
বিয়েবাড়ির এই গ্যাদারিং টা একদম পোষায় না অর্কর, এই ধরনের ফ্যামিলি প্রোগ্রাম সে একটু এড়িয়েই চলে,কিন্তু আজ ব্যাপার অন্য, বেস্টফ্রেন্ড শৌনক এর বিয়ে, তাই বাধ্য হয়ে আসতেই হয়েছে তাকে, শৌনক তো একপ্রকার বলেই দিয়েছিল “ তুই না এলে আমি ভাই বিয়েই করছিনা আর হ্যাঁ শুধু বিয়ে নয়, বিয়ে থেকে শুরু করে রিসেপশন সবকিছুতেই তোর থাকা মাস্ট।”
অর্ক সেদিন অনেক করে কাটানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে পারেনি, বলেছিল, “ আমি ভাই কন্ট্রাক্ট এ আছি, নেক্সট উইক এর মধ্যে আমাকে নভেল সাবমিট করতে হবে, প্লিজ ভাই…….” না এই অনুরোধ কিন্তু মানা হয়নি। শৌনক এর কড়া জবাব, “ গেলে যাবে কন্ট্রাক্ট, একটা গেলে ১০ টা আসবে, কিন্তু বিয়েতে তোর আসা চাই”।
তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে ওকে আসতে হয়েছে। পেশায় অর্ক লেখক, লেখালিখি ছোট থেকেই করে, পেশাগত ভাবে সে লিখছে আজ প্রায় ৭ বছর, তার এই ২৯ বছরের জীবন কালে অনেক খ্যাতি সে অর্জন করেছে, লেখার পাশাপাশি একটা এন জি ও চালায় সে, কলকাতার পথশিশু দের পুনর্বাসনের জন্য।তাই শৌনক কে সে বলেছিল, “ দেখ আমি গেলে আমার বাচ্ছা গুলোও কিন্তু যাবে”।
“কোই বাত নেহি” বলে হেসেছিল শৌনক। আজ রিসেপশন এর দিন অর্কর এন জি ও এর বাচ্ছাদের এখানেই খাওয়ার কথা, তাই সে বাইরে এসে তাদের অপেক্ষা করছিল। ঠিক তখন ই, নিজের ডানহাতে হাতঘড়ি তে একটু টান অনুভব করে সে।
“ এক্সকিউজ মি, ক্যান ইউ প্লিজ হেল্প?” হঠাৎ এই নারীকন্ঠে ঘাবড়ে যায় সে। ঘুরে গিয়ে দেখে তার ঘড়ি তে সেই মহিলার ওড়না আটকে গেছে, তাড়াতাড়ি করে অর্ক সেটা খুলে দেয়। মেয়েটি এসে হাসিমুখ এ বলে, “ হাই আমি অনন্যা, ইউ মাস্ট বি অর্ক, তাই না? ঠিক ই শুনেছি শৌনক এর মুখে, একেবারে টিপটপ,” বলেই হাত বাড়িয়ে দেয় সে, অর্ক শুধুই সৌজন্যমূলক হাসি হেসে হাতমেলায়।
অনন্যা আবার বলে, “ আমি শৌনকের আই আই টি এর ফ্রেন্ড, বলতে পার আমরা একই বিষয়ের ওপর পি এইচ ডি করেছি, এখন আমি হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটি তে পড়াচ্ছি, সবে একবছর হল আর কি।
ছুটি পাইনি তাই পুরো প্রোগ্রাম টা মিস করলাম, আজ কোনরকমে এখানে আসতে পারলাম, নাহলে শৌনক আমাকে মেরেই ফেলত” বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সে।
এইসমস্ত কথাবার্তা অর্কর ঠিক পোষাল না, কোনরকমে একটা ঠান্ডা হাসি হেসে বলল, “ ওকে, আই সি, বাট আমি এখানে একজনের অপেক্ষা করছি, সো সরি, আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি।” বলে কোনরকমে সে অনন্যার থেকে পিছু ছাড়াল সে।
বাইরে এসে খোলা হাওয়ায় খানিকটা নিঃশ্বাস নিল সে
শ্রুতির সাথেও তার এভাবেই ফিল্মি ভাবে দেখা হয়েছিল, পাড়ার সরস্বতী পুজো তে, এই একই ভাবে ঘড়ি তে ওড়না আটকে যাওয়া, ওই একই খিলখিলিয়ে হাসি, সব যেন মিলে যাচ্ছে, গলা ভারী হয়ে আসে অর্কর। না,না শ্রুতি জীবিত, এবং খুশি, তার বর অভিলাষ আর মেয়ে নীলাশার সাথে, খুশি তো নেই আমাদের লেখক বাবু।খুব দ্রুত শ্রুতির সমস্ত কথা তার যেন মনে পড়তে লাগল, তাদের প্রথম আলাপ, কথা বলা, প্রেম, ডেটিং এবং শেষমেষ যা হয়, ব্রেকআপ, প্রায় চার বছর প্রেম করার পর ছাড়াছাড়ি, মনে আছে তার লাস্ট মিটিং টা, মাস্টার্স করে সবে সবে লেখালেখি নিয়ে স্ট্রাগল করছে তখন অর্ক, কালীঘাটের তন্দুর হাউসেই হয়েছিল তাদের লাস্ট মিটিং,
“ শুনেছিস তো, আমার বিয়ের ঠিক হয়েছে,
“ হ্যাঁ, শুনলাম, কি করে পাত্র?”
“ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, সুইজারল্যান্ড এ চলে যাবে আফটার ম্যারেজ
অর্ক হেসে বলেছিল, “ তুই আর একটু সময় দিতে পারতিস, আমাকে, ঠিক করে…….”
শ্রুতি রেগে বলেছিল, “ কি ঠিক করতিস, কি করছিস এখন তুই, কোন ফিক্সড স্যালারি আছে তোর, কোন ফিউচার আছে? তার থেকে লাইফ একটা চান্স দিয়েছে আর আমি সেটা নেবনা, আর কিই বা বলব বাবা মা কে, স্ট্রাগলিং রাইটার…..তা যদি একটু তোর সেভিংস থাকত…..যাক গে ছাড় ব্রেক আপ তো হয়েই গেছে, একটা জিনিস বলব, কিছু পদের কাজ কর, এতে কিসসু হবেনা,
বুক ফেটে গেছিল অর্কর, সে বলেছিল,” তোর তো আমার লেখা ভাল লাগত……..
শ্রুতি বলেছিল,” তো, বাচ্ছা ছিলাম আমি, আর শোন বাস্তবে ফিরে আয় ওসব রাবিশ লিখে কিছু হবে না।”
রাবিশ ই বটে তাই তো, সাহিত্য একাদেমি থেকে দু বার পর পর সেরা ঔপন্যাসিক এর পুরস্কার পেয়েছে সে। সেদিন এর পর থেকে শ্রুতি এর কথা আর মনে করার চেষ্টা করেনি অর্ক। আজ হঠাৎ অনন্যাকে দেখে এসব মনে পড়ে গেল তার। বিশেষ করে ওর হাসি, অর্কর মন কে তছনছ করে দিচ্ছে, তাই সে বাইরে বেড়িয়ে এসেছে।
অন্যদিকে অর্কর এহেন ব্যবহারে, খুবই অবাক হল অনন্যা, হতে পারে অচেনা মেয়ের সাথে কথা বলতে একটু লজ্জা হয়, কিন্তু এ তো রীতিমতো অভদ্রতা করল, নেহাৎ কম সুন্দরী নয় অনন্যা, তাও এভাবে তাকে এড়িয়ে গেল অর্ক, নিজেকে ভাবে কি, রবীন্দ্রনাথ নাকি শরৎচন্দ্র, এসব ভেবেই মনে মনে যথেষ্ট রেগে গেল সে।
তখনই পেছন থেকে সে শৌনক এর গলার আওয়াজ পেল, “ কি রে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?”। বেজার মুখ নিয়েই অনন্যা তার দিকে ঘুরে তাকাল সে। “ কী রে, এরকম হুতোম প্যাঁচার মতো মুখ করে আছিস কেন রে?” অবাক হয়ে শৌনক তাকে জিজ্ঞেস করল। অনন্যা বলল, “ আরে তোর ওই বেস্ট ফ্রেন্ড…”।
শৌনক হেসে বলল, “ও আচ্ছা, বুঝেছি, দেখা হয়ে গেছে, তা কি কথা হল তোদের?” “কথা!” অবাক হয়ে বলল অনন্যা। “ শোন শৌনক হতে পারে বড় লেখক, কিন্তু এত ঘ্যাম কিসের বলতে পারবি, যেচে গিয়ে আলাপ করলাম কিন্তু কোন কথাই শুনলনা, কেমন যেন অভদ্র একটা!”
“ আরে না তুই ওকে ভুল বুঝছিস, ও এরকম মোটেও না….” শৌনক সাফাই দিল, “ আমি ঠিক ই বুঝেছি “ অনন্যা জেদ নিয়ে বলল। শৌনক শান্ত হয়ে বলল, “ জানিস না তুই ওর ব্যাপারে কিছু তাই এসব বলছিস”।
অনন্যা বলল, “ বেশ শুনি কি বলবি।”
শৌনক একে একে অর্ক আর শ্রুতির সমস্ত কথা বলে গেল একে একে। সব শুনে অনন্যা বলল “ এরকম সবার সাথেই হয় তাবলে, নিজেকে এরকম অভদ্র বানাব এটা কিন্তু ভুল”।
শৌনক হেসে বলল, “ সেটা ওউ ভালো জানে, আসলে আমি অর্ককে আজ নয় সেই কলেজ এর প্রথম দিন থেকে চিনি, ও খুব মিশুকে আর খুব ই হাম্বল, কোনদিন ওকে ডিপ্রেশনে যেতে দেখিনি যতদিন না অব্ধি শ্রুতি ওর জীবনে এল, প্রথম প্রথম দেখতাম অর্ক এর লেখা শ্রুতির কাছে বেদবাক্য ছিল, অর্কও বলত যে ওর লেখার একমাত্র ইন্সপিরেশন হল শ্রুতি, ধীরে ধীরে শ্রুতি অর্কর ওপর যেন ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলছিল, যে লেখা দেখে সে প্রেম এ পড়েছিল, সেই লেখার কথা শুনলে সে রেগে যেত, বহু ঝামেলা হত, আমি বুঝতাম শ্রুতি অর্কর ফেম টা নিতে পারেনা, ওর প্রশংসা সহ্য করতে পারে না, অর্ককে আমি অনেক বোঝাতাম ও বুঝত না, বলত সব ঠিক হয়ে যাবে,শেষমেষ আর কিছু ঠিক হল না।
জানিস আমার বোকা বন্ধু টা কি বলত, “ যে আমার অগোছালো আমিটাকে ভালবাসে, সেই আসল ভালবাসার মানুষ”, হাহা এটাও জানত না যে গোছাল মানুষদের ই দুনিয়া কদর করে, তাই এখন দেখ সবসময় গোছাল।” এতটা শুনে অনন্যা বলল, “বুঝলাম, কিন্তু তূই যা বললি তার উল্টো টাও তো হতে পারে, হতেই পারে অর্কই খুব ইগোইস্টিক।”
“ হতেই পারে” শৌনক বলল,” কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে শ্রুতি কিন্তু ভালোই আছে, কিন্তু আমার বন্ধু যে ভাল নেই সেটা সবাই বলবে, আর ওই যে আমি আমার বন্ধু কে চিনি। আসলে কি জানিস সমস্ত বিচ্ছেদ এর পিছনে ছেলেটিকেই আমরা কালপ্রিট বানাই, কিন্তু উল্টোটাও পসিবল তাই কিনা”. অনন্যা শুনে বলল” হুম”।
ততক্ষনে একটা বাস এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, দরজা খুলতেই বাস থেকে নেমে আসে অনেক বাচ্ছা, অর্ক তাদের নিয়ে গিয়ে ভেতরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে থাকে। এসব কিছু অনন্যা খুব মন দিয়ে দেখে, বুঝতে পারে এদের জন্যই সে অপেক্ষা করছিল, খানিকটা মন নরম হয় ওর, না ছেলেটা অতটাও খারাপ না।শৌনক বলে “ এই যে বাচ্ছা গুলো দেখছিস, সব্বাই কে অর্ক নিজের এন জি ও তে রেখেছে, এখন দুটো জিনিস ই ওর জীবন, লেখালেখি আর এই এন জি ও।” সত্যি ছেলেটা ভাল কাজ করছে, মনে মনে ভাবে অনন্যা
সেদিন তারপর থেকে অনন্যার চোখ এড়ায়নি অর্ককে, রাত্রে যখন খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হল, অর্ককে পেছন থেকে ডাকল সে, “ হ্যালো মি। রাইটার” অবাক হয়ে অর্ক পেছনে ঘুরল সে, একগাল হাসি নিয়ে অনন্যা এগিয়ে আসে আর বলে, “ সব শ্রুতি ভাল শ্রোতা হয় না, কিন্তু তাবলে নিজের গল্প কে কি পাল্টান ভাল? অগোছালো মানুষকেই আমার বেশি ভাললাগে।” বলেই সে চলে গেল সেখান থেকে, কথা গুলো শুনে এতটাই অবাক হল অর্ক, যে কিছু করতেই পারল না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল অনন্যার দিকে,যতক্ষণ না সে তার চোখের বাইরে চলে যায়।