তখন রাত ৯ টার বেশি হবে।
আমি বাসের জানালা দিয়ে লাল নীল হলুদ বাতি দেখি চারিদিকে। এ সমাজে লাল নীল হলুদ বাতির জয়জয়কার। কোনো অনুষ্ঠান কিংবা উৎসব দেখলে মনে হয় এ যেনো পরীদের রাজপ্রাসাদ।আলোকসজ্জায় পরিপূর্ণ।
যাইহোক,হয়তো সমাজের পরিপূর্ণ রূপদানই ইহার সৌন্দর্য।
আমি সারাদিন কর্মব্যস্ততা সেড়ে বাসার উদ্দেশ্যে বাসে উঠে এসব আলোকসজ্জা দেখে সারাদিনের ক্লান্তিতে জানালায় মাথা ঠেস দিয়ে দেখতে থাকি মানুষের যাতায়াত। সারাদিনের কাজের কথা, সহকর্মীদের কথা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাঝে মধ্যেই মুখে মুচকি হাসি চলে আসছে।এরকমটা আমাদের হবার হয় মাঝে মধ্যে।
আমি লাল নীল হলুদ বাতি দেখতে দেখতেই আমার পাশের সিটে এক বুড়ো লোক এসে বসলেন।বয়স আনুমানিক সত্তর আশি হবে।মুখে থোকা থোকা পাকা দাড়ি,চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা,গায়ে সাদা পাঞ্জাবি ,বড় একটি ব্যাগ আর হাতে সোনালী রঙের একটি লোহার লাঠি।
বুড়ো লোকটি পাশে বসেই পকেট থেকে এক পলিথিনের পুটলি বের করে দুটো পান জর্দ্দা সুপারি দিয়ে মুখে চালান করে দিলেন ।
আমি তার চাঁদের মাটির মত এবড়ো থেবড়ো মুখে পান চিবানো দেখে কিছুটা বিরক্তই হই।তার উপর আবার হাতে চুন নিয়ে বাসের সিটে মুছতে লাগলো। আমার রাগে গা জ্বলে পুড়ে আঙ্গার হয়ে যাচ্ছে।শালার, আমার বয়সী কোনো লোক বসলেও তো গালগল্প করে রাতটা পার করে দেওয়া যেতো।অথবা পাশের সিটটি খালি পড়ে থাকলেও পারতো!উপরওয়ালা কেনো আমার পাশে এই আধমরা লোকটা কে বসতে পাঠালেন?
এই লোক তো একটু পরেই কাশতে শুরু করবে।হয়তো কাশতে কাশতে বমি-টমিও করে দিবে।এই রাতে পাশের সিটে কোনো সুন্দরী রমনী বসলেও তো পারতো?রাতটা অন্তত খুব ভাল কাটতো!
হঠাৎ বৃদ্ধ আমার সামনে দিয়ে মুখ বাড়িয়েই জানালা দিয়ে পানের পিক ফেললেন। জানালা দিয়ে সম্পন্ন পিকটি বাইরে না গিয়ে অর্ধেক অর্ধেক গেল।আমার উরু পানের পিকে লাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন রক্ত বের হচ্ছে।
আমি বৃদ্ধার দিকে তাকাতেই বৃদ্ধা ফিক করে বত্রিশ পাটির দাঁত বের করে হেসে দিলেন।বললেন, “দাদা ভাই আমি ইচ্ছে করে দেইনি।” এই বলেই বৃদ্ধা আরেকটি পান বের করে মুখে চালান করে দিলেন।
রাগে আমার গা মেজমেজ করতেছিল।নিজেকে ঝেড়ে মুছে মোবাইল টিপতে শুরু করি।কিন্তু কিছুক্ষণ টিপার পর মোবাইলও বিরক্ত লাগতে শুরু করলো।তাই বিভিন্ন জায়গার ছবি দেখতে শুরু করলাম।ওমন সময় এক ফ্রেন্ড করে খোঁজ নিলো কোথায় আছি,কিছু বই দরকার দিবো,কবে দেখা করার সময় হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ।প্রায় মিনিট পাঁচেক কথা বলে লাইন কাটতেই বৃদ্ধা বললেন,’কোথায় যাবে দাদা ভাই?”
আমি সামনের দিকে তাকিতে উত্তর দিলাম ‘উত্তরা যাব।”
_আপনি?
_আমি স্টেশনরোড যাব।
_কে ফোন করেছিল দাদা ভাই?উনি নাকি?
আমি জোড়ালো ভাবেই হাসতে থাকি।তারপর হাসি থামিয়ে বললাম-
_না দাদা উনি নেই।ফ্রেন্ড ছিল।
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বৃদ্ধার কথা শুনে।উনি এসবের কি বুঝেন?
_দাদু কে নিয়ে আসেন নি?আমি প্রশ্ন করলাম।
এবার বৃদ্ধা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন –
_দাদু? তোমার দাদু তো হয়নি আমার!
আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম।ঠিক তৎক্ষণে বাস ছেড়ে দিয়েছে।
যদি কিছু মনে না করেন একটু বলবেন?আমি প্রশ্ন করলাম।
বৃদ্ধা অন্যমনস্ক হয়েই ব্যাগ থেকে একটি নীল ডায়েরি বের করলেন।তার সাথে আরো একটি পানও।পানটি মুখে পুড়তে পুড়তে বৃদ্ধা বললেন,
“মানুষ বুড়ো হয় কিন্তু স্মৃতি কখনো বুড়ো হয় না।স্মৃতি অনেকটা হিজল গাছের পাতার মতো। আজন্ম সবুজ ।শ্মশানের চিতায় পুড়তে পুড়তেও মানুষ স্মৃতি উল্টায়,কল্পনা দেখে!
তখন আমার বয়স বেশি না।চৌদ্দো কি পনেরো হবে।ফুটফুটে সুন্দর গড়ন,ছিপছিপে দেহ।স্যাররা আমাকে খুব ভালবাসতেন।তাদের কথার ওপর কোনোদিন কথা বলিনি,বেয়াদবী করিনি।আমি তখন ক্লাস টেন-এ পড়ি।ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিলাম।তাই স্যারদের কোনো না কোনো কাজ আমাকে করতেই হতো।স্যাররা আমাকে দেখলেই ডাক দিতেন।
‘এই সুবোধ ,এদিকে আসো তো বাবা। ‘
স্যাররা গল্প করতেন,এটা ওটা বলতেন এবং শেষে দশ টাকার একটি চকচকে নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন বাদাম কিনে আনতে।আমি নিরীহ প্রাণীর মতন লাল দশ টাকার নোটে চোখ বুলাতে বুলাতে বাদাম কিনে আনতাম।আসার পর স্যাররা আমাকে এক মুঠো বাদাম দিতে ভুল করতেন না।

তখন চৈত্র মাস।
মাথার উপর রৌদ্র খাঁ খাঁ করিতেছে।স্কুল থেকে এসে বই টেবিলে রাখতেই পাড়ার এক বন্ধু এসে বললো,’সুবোধ,তোর ছাত্রী মারা গিয়েছে। সকালে কি যেন হলো তারপর ঘরের দরোজা বন্ধ করে রাখে ওর মা।শুনলাম অরুণা নাকি গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে!’
আমার মাথায় আকাশ,পাহাড়,গাছপালা মনে হলো সব একসাথে ভেঙে পড়েছিল।আমার দশটা না পাঁচটা একটা মাত্র স্টুডেন্ট ।দুইশত টাকা পড়িয়ে পেতাম।যাক শালার,দুইশত টাকাও হাতছাড়া হল।এখন কি করি? সিগারেট খাওয়ার টাকা পাই কোথায়?বাবা মাও তো আর সিগারেট খেতে টাকা দিবে না।
অরুণাকে মূলত আমার এক স্যার ঠিক করে দিয়েছিলেন পড়ানোর জন্য।পড়াতে পড়াতে আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক সময় ।কিন্তু অরুণা মারা গিয়েছে শুনে বুকের ভেতর ছট করে ওঠলেও তাকে দেখার তড়িঘড়ি না দেখে বন্ধুটি চলে যায়।
আমি চেয়ারে বসে ভাবছি অরুণা কেনো মারা যেতে পারে।কি হল ওর?
আমি কখনো কারো অযথা বকবক শোনার শ্রোতা ছিলাম না।অতিরিক্ত বকবক শোনার ধৈর্য আমার নেই।কিন্তু কেনো জানি এই অপরিচিত বৃদ্ধার কথা আজ মনপ্রাণ দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করছে।
শুনতে শুনতে আমার চোখেও জল গড়াচ্ছে।তবে কি আমার ধৈর্য ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে?দাদু আবার বলতে শুরু করলেন:
অরুণাদের বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে দশ মিনিটের দূরে ।আমি প্রতিদিন বিকেলে ওকে পড়তে যেতাম।ক্লাস সেভেন-এ পড়তো অরুণা।দেখতে বেশ সুন্দর ছিল।বেশ লম্বা কেশ,হরিণের মত কাজল কালো চোখ ,গোলাপি রঙের ঠোঁট।এককথায় অরুণা ছিল পরী।তবে অরুণা পড়াশোনাতেও বেশ ভাল ছিল।কোনো কিছু একবার বলে দিলে তা আর দ্বিতীয়বার বলতে হতো না।কিন্তু পড়াশোনায় অরুণা ভাল হলেও বুদ্ধিতে ছিল নির্বোধ।
সুন্দরী মেয়েরা বেশির ভাগই বুদ্ধিহীন হয়ে থাকে। আর সেই দলে অরুণাও ছিল।
ছাত্রী পড়াতে পড়াতে যে আমার ভেতর প্রেম জমা হয়েছে সে বিষয় আমার হয়তো কখনোই জানা হতো না।যদি না অরুণা সেদিন আমাকে দুষ্টামির ছলে ‘ভালবাসি’ না বলতো।
এক বিকেলে পড়াতে গেলে অরুণা পেট ব্যথার কথা বলে ভান ধরে শুয়ে থাকে।এমন ভাবেই ভান ধরেছিল যে তাকে কেউ দেখলে ভাববে আসলেই ওর ভীষণ পেট ব্যথা উঠেছে। অরুণা বিছানায় শুয়ে কৃমি রোগীর মত ছটফট করতেছিল।আমি অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়েই থাকি।মাঝে মধ্যে অরুণা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতো।
অরুণার মা রান্না ঘরে চুলোয় আগুন জ্বালাচ্ছে আর বলছে,’বাবা সুবোধ, আমার পেটের মেয়েকে আমি চিনি।ওর কোনো পেট ব্যথা ওঠেনি।ওকে টেনে তুলে পড়াতে বসাও।না হয় লাঠি দিয়ে মারো।’
অরুণাকে সাত মাস হলো পড়াই।কখনো হাত তুলিনি বা বকাও দেইনি।তাই ওর মায়ের অনুমতি পেয়ে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে চকির কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টান দিতে যাব ওমন সময় অরুণা আমার গলা ঝাপটে ধরে শুয়ে পড়ল।হয়ে গেলাম দুজন দুজনার দেহরক্ষী!তখন অরুণা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,’তোমাকে ভীষণ ভালবাসি সুবোধ দা।’
আরো পড়ুন
আমি স্টুডেন্ট পড়াতাম টাকার জন্য।আমার সিগারেট কেনার টাকার জন্য।কিন্তু সিগারেট কেনার টাকা রোজগার করতে গিয়ে রোজগার করলাম এক ‘জীবন’।
বেশির ভাগ ছেলেদেরই এই ঘটনা ঘটে।টাকা রোজগারের বদলে ‘টাকা ও জীবন’ দুটোই রোজগার করে।আমিও অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাই করলাম।
অরুণা আমাকে ভালোবাসতো পাগলের মত।কোনো বিকেলে যদি না যেতাম পড়াতে তাহলেই সে চলে আসতো আমার বাড়ি।আর এসেই সেই রকম রাগ চোখে মাকে যা তা বলে যেতো।
__ সুবোধ স্যার কোথায় কাকীমা?
__আজ পড়াতে যায় নি কেনো?
__টাকা কি গাছের পাতা যে মাসের মধ্যে বিশ দিন পড়িয়েই পুরো টাকা নিয়ে আসবে।উনাকে বলে দিবেন আর পড়াতে যেতে হবেনা।মা অন্য শিক্ষক দেখবেন আমার জন্য।
অরুণার রাগে চোখে জল ছলছল করছিলো।সুন্দরী মেয়েরা রাগের সময় চোখের জল সামলাতে পারেনা।মুখমন্ডল লাল হয়ে যায়।
অরুণা চলে যাওয়ার সময় পিছনে ফিরে আবার বলতে শুরু করলো:
__মাস শেষ হতে না হতেই টাকা দিয়ে দেয় বলে মনে করেছে তাকে সারাজীবনের জন্য রেখে দিয়েছি।
__বলে দিবেন কাল যেনো পড়াতে যায়।আগামী মাসে উনার বেতন বাড়িয়ে দিবে মা বলেছে।
আমার মা নিরীহ প্রাণীর মত অরুণার দিকে চেয়ে থাকতো।আর আমি বাড়ি আসলে মা আমাকে রাগারাগি করতেন।
“কেনো পড়াতে যাও না?ওরা এসে রাগারাগি করে যায় ভালো লাগে তোমার কাছে?তোমার জন্য তোমার বাবা মা মানুষের মুখে কথা শুনবে বুঝি?আরো কয়েকটা স্টুডেন্ট খুঁজেও তো পড়াতে পারো।তোমার হাত খরচ টা চলে যেতো।”
আসলেই ছেলের জন্য বাবা মা কথা শুনতে হবে এ মানা যায় না।কিন্তু শত হলেও তো আমরা তাদের সন্তান। তাই হয়তো অন্যের কটু কথা শুনতে পারেন।
মা আমাকে আরো কয়টা স্টুডেন্ট খোঁজ করার কথা বলতেন।কিন্তু কখনোই আমার কাছে টাকা চাননি।উলটো মাঝে মধ্যেই কয়েকটি লাল চকচকে নোট আমার হাতে দিতেন।আর আমি সবগুলো দিয়েই সিগারেট খেতাম।

আমার খারাপ অভ্যাসের মধ্যে সিগারেট খাওয়াই ছিল প্রথম।
ওতদিনে আমার ও অরুণার প্রেম গভীর সাগরের মতই গভীর হয়েছে।কেউ কাউকে না দেখলে মনে হচ্ছিলো এক মিনিটেই মরে যাচ্ছি।সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। দুটো জীবন যেনো এক সুঁতোয় বাধা।অল্প বয়সের প্রেম এমনই হয়।
আস্তে আস্তে অরুণার সাথে আমার স্কুল ফাঁকি হতো।আমরা স্কুলে না গিয়ে ঘুরে বেড়াতাম।মাঠে,পার্কে,সমুদ্র পাড়ে ঘুরে বেড়াতাম।সমুদ্রের বালিতে দু’জনার নাম লিখে তা পানির স্রোতে ভাসিয়ে দিতাম।আর এভাবেই চলতো আমাদের স্কুল ফাঁকির দিনগুলো।
একদিন অরুণা আমাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে আঁচার কিনে আনতে বলেছিল।আমি স্বযত্নে লাল চকচকে একটি দশ টাকার নোট দিয়ে এক পলিথিন আঁচার কিনে আনি।কিন্তু সেই আঁচার অরুণা খেতে পারলো না।আমার মায়ের প্রচন্ড মাথা ব্যথা উঠলে মা আঁচার টুকু খেয়ে ফেলে।
বিকেলে অরুণাকে পড়াতে গেলে অরুণা আমার হাতের দিকে নিঃস্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।তারপর অন্যদিকে মুখ করে বলে-
_আমার জন্য আঁচার আনোনি সুবোধ দা?
_তোমার কাছে কি আমি বেশী কিছু চেয়ে ফেলেছিলাম?
_আচ্ছা,আর কখনো বলব না কোনো কিছুর কথা।
আসলে প্রথম প্রথম ভালবাসা গুলো রাগ অভিমানে তৈরি হয়।যখন যা বলবে তখন তাই করতে হবে প্রেমিকের।বিষের পেয়ালায় চুমুক দিতে বললেও তাই করতে হবে।অবুঝ মেয়ের মত নানা ছল বাহানা করে থাকে প্রেমিকা।মেয়েদের মন বুঝতে হবে।যখন যা চাইবে তখন তাই করতে হবে তা না হলে মুখ অমাবস্যার অন্ধকারে পরিনত হবে।
আমি কথা বলতে যাব ওমন সময় অরুণার মা চলে আসে চা-বিস্কুট নিয়ে। আমি করুন চোখে অরুণার দিকে তাকিয়ে থাকি।আর সেদিন বেশি না পড়িয়েই আমি বাড়ি ফিরি।
অতদিনে আমাকে অরুণার বাড়ির সবাই ভাল জানতে শুরু করে। কারো কোনো জরুরি কাজ হলেই আমাকে ডাকা হতো।আর আমিও করে দিতাম অরুনার দিকে চেয়ে।
আমি আরো দুইটি স্টুডেন্টও পাই।সেই সুবাধে অরুণাদের বাড়ি হয়ে ওঠে আমার খেলার আস্তানা।আমরা একসাথে কানামাছি খেলতাম,গোল্লাছুট খেলতাম,সকাল বিকেল নদীতে স্নান করিতাম,গলা ছেড়ে বেহুলা সুরে গান গাইতাম,ঘাসফড়িং ধরতাম,শালুক তুলতাম,কানামাছি খেলার ছলে একজন আরেকজন কে ছুয়ে দেখতাম।অরুণা তখন মিটমিট করে হাসতো আর মুখ বাকিয়ে ভেংচি কাটতো।
আসলে অল্প বয়সী মেয়েদের দুষ্টামিতে আনন্দ থাকে।এই বয়সী মেয়েদের দুষ্টামি তে ছেলেরা কাত হয়ে যায়।আমারও তাই হয়েছিল।মজেছিলাম অরুণার অথই প্রেমে।
একবার আমি বল খেলতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পাই।অরুণাকে পড়তে যাইনি বলে সে চলে আসে আমার বাড়িতে।এসেই মা কে যা তা বলে চলে যায়।আমি ঘরের ভেতর শুয়ে আব শুনলাম।
সেদিন তার রাগ মাখা কন্ঠে ছিল সবই প্রেম মেশানো।মানুষ সুন্দরের প্রেমে পড়ে আর আমি আবার সেদিন অরুণার রাগ মাখা কথার প্রেমে পড়ি।এ প্রেম অদেখা -অকৃত্রিম।
সেদিন থেকে আমাদের সম্পর্ক টা এক ভিন্নরূপ পায়।কাধে কাধ রেখে, হাতে হাত রেখে সকাল কে দুপুর, দুপুরকে বিকেল করে দিতাম।
যা সাক্ষী হয়ে থাকতো গাছপালা, নদীনালা,ইটপাথর, ধুলোবালি।
এতদিন অরুণা আমার কাছে বায়না ধরিতো আঁচার খাবে,ঘুরতে যাবে,বেশি বেশি পড়াতে হবে। কিন্তু এক বিকেলে অরুণা বায়না ধরে বিয়ে করবে।কিন্তু আমি তখন কিছু বলার সাহস পাইনি।ওর হাসি মাখা মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তা বলতে পারব না।
অরুণা আমার হাত ধরে সেদিন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মত হেটেছিল।আমি সেদিন ওর কথা শুনে বোকাই হয়েছিলাম।
অরুণা আমার নাক টেনে দিয়ে বলল,কি বিয়ে করবে না?আমি মাথা ঝাকালাম।
অরুণা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আমাকে খুব করে জড়িয়ে ধরে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি।
এবার বৃদ্ধ লোকটি একটু চুপ করে গেল।আমিও আর কিছু বললাম না।হয়তো গলা শুকিয়ে গিয়েছে কিন্তু না।তার চোখ জলে ছলছল করতেছিলো।আমি পকেট টিসু দিলাম তাকে বের করে তার হাতে।বৃদ্ধ লোকটি চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করলেন:
জানো,আমি কখনো অরুণার কোনো কিছুর আবদার ফিরিয়ে দেইনি।শুধুমাত্র বিয়ের আবদারটি ছাড়া।তবে আমি ওকে বলেছিলাম আমরা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিয়ে করব।বাবা মা কে জানিয়েই করব।
অরুণা কিছুই বলেনি সেদিন।শুধু বলেছিলো একটি কথা।’আমাকে কস্ট দিও না সুবোধ দা ।তোমাকে অনেক ভালবাসি।তোমার বুকে মাথা রেখেই জীবন পার করে দিতে চাই সুবোধ দা।কখনো আমাকে ভুল বুঝো না ।’
এক সকালে আমরা স্কুলে না গিয়ে নদীর তীরে ঘুরতে যাই।নদীর পাড় অরুণার বেশি পছন্দ ।জেলেদের জীবন যাপন, নদীতে পানকৌড়ির ছুটোছুটি ,পানির কল্লোল এইসব-ই অরুণা মাঝে মধ্যে দেখতে আসতো।আর আমাকে তা পড়ার টেবিলে বসে শোনাতো।
আমিও শুনতাম ওর মিষ্টি কন্ঠে।অরুণা নদীর তীরে আমার কাধে মাথা রেখে গালগল্প করতেছিল।ওর চুল বাতাসে আমার নাক,মুখ স্পর্শ করতে থাকে।এ এক অন্যরকম শিহরণ তোলে।দুজন দুজনাকে কাছে পাওয়ার শিহরণ।
আমি বিকেল বেলা অরুণাদের বাড়ি যাই।অরুণাকে শেষবারের মত দেখতে।আজীবনের দেখা দেখতে।শেষ কৃতি করতে।
বাড়ির সবাই আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।আমি নিচের দিকে তাকিয়ে অরুণাদের ঘরে প্রবেশ করি।প্রবেশ করেই দেখতে পাই অরুণার মা পাগলের মত হয়ে মাটিতে বসে আছেন।আমাকে দেখতে পেয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,স্যার আসছেন অরুণাকে পড়াইতে?অরুণা আর পড়বে না।সর্গে গেছে স্যার আর আসব না।
আমি অরুণার মা কে জিজ্ঞাসা করলাম, কাকীমা,কিভাবে এমন হলো অরুণার?
_স্যার,গলায় রশি দিছে স্যার।
_কেনো দিয়েছে কাকীমা?
_জানিনা স্যার।আমি সকালে ওরে ঘরে আটকাইয়া রাখছিলাম যাতে বাইরে টইটই করতে না পারে।সারাটা দিন একলা একলা কাম কাজ করি ওরে খুঁজেও পাইনা একটু কাম করাইতে।সারাদিন ঘুরে বইটই নিয়া বয় না।কি জানি বইয়া বইয়া লেখে রাত্রে কিন্তু একটু শব্দ কইরাও পড়ে না………
আমি কিছু বলার আগেই পাড়ার সেই বন্ধুটি আমার হাতে একটি ডায়েরি ও একটি কাগজ দিয়ে চলে যায়। আমি কাগজে চোখ বুলালাম আর ডায়েরিটি হাতে করে চলে আসি।
আমি অরুণাকে দেখতে পারিনি শেষ বারের মত।তার আগেই অরুণাকে শ্মশানের কঠিন আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।এক জীবনের সব সুখ, দুঃখ-কস্ট ধূলিসাৎ করে চলে গেল অরুণা।আমি শ্মশানে গিয়ে অরুণার আগুনে পোড়া দগ্ধ দেহের ছাইয়ে হাত বুলাতে থাকি।আমার চোখে তখন অথই পানি।আমি যেন চারিপাশে অরুণাকেই দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমি বাড়ি ফিরে রাতে ডায়েরি আর কাগজটি খুলে দেখলাম অরুণা আমাকে নিয়েই সকল লিখা লিখেছে।কাগজের লিখাটা ছিল এরকম:

প্রিয় সুবোধ,
প্রথমেই আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে কখনোই ঠকাতে চাইনি। আর তাই বেছে নিয়েছি নিজের মৃত্যু। জানো,আমি কখনোই চাইনি অন্য পুরুষ আমাকে ছিবলে খাক,পৃষ্ঠ করুক
।আমি যেদিন তোমাকে বিয়ের কথা বলেছিলাম ঠিক তার কিছুদিন আগে আমি বুজতে পারি আম্মা বিয়ের জন্য সঞ্জয় ঘটককে ভাল পাত্র দেখতে বলেছেন।কারণ ,সঞ্জয় ঘটক আর মা দেখতাম মাঝেমধ্যেই বিয়ে নিয়ে কি সব আলাপ যেন করতেন।
একদিন আমি বাড়ির বাহির হতে যাবো ওমন সময় সঞ্জয় ঘটককে বাড়ির দিকে আসতে দেখে আমি আর বের হইনি।সেদিন আমি চুপটি করে সব কথা শুনি।জানতে পারি দুবাই প্রবাসী এক ছেলের সাথে আমার বিয়ে হবে।ঘটক সঞ্জয় দা সবকিছুই ঠিকঠাক করেছে।কিন্তু আমি তা মানতে পারিনি। আম্মা আমাকে দুপুরবেলা ভাত প্লেটে বললেন আমি যেন ঘরের বাহির বেশি বের না হই।আমি নাকি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াই।আমি কিছু বলার সাহস পাইনি সেদিন।
জানো,আমার গলা থেকে তখন আর ভাত নামছিলো না সুবোধ দা।আমার কাছে তখন ভাদ্র মাসের আকাশের মত সব পরিষ্কার হয়ে গেল যে তোমাকে আমার আর পাওয়া হবে না।কিন্তু আমি তো তোমাকে ছাড়া জীবন চালাতে পারব না অন্যের ছায়াতলে।তোমার মত কেউ আমাকে ভালবাসবে না সুবোধ দা।এক জন্মে তোমার কাছে যে ভালবাসাটুকু পেয়েছি তা অন্য কেউ দিতে পারবে না সুবোধ দা।তোমার কাঁধে মাথা রেখে আমি যে শান্তি খুঁজে পেয়েছি তা অন্য কাঁধে কখনো পাবোনা।
সুবোধ দা, তোমার কাছে অনুরোধ রাখি : শেষবারের মত আমায় একনজর দেখে যেও।আমার শেষ কৃতে এক মুঠো ধূলো দিও।আমি সর্গে যেয়েও শান্তিতে থাকতে পারব।আমি জানি আমি যা করছি তা অন্যায় কিন্তু এ পথ ছাড়া আমার অন্য কোনো পথ ছিল না।
সত্যিকারের ভালবাসা হয়তো চিতায় পুড়েই বিসর্জন হয়।নয়তো দিতে হয়।যদি বেচে থাকি তবে তোমায় না পাওয়ার দহন বুকে নিয়ে আজীবন চলতে হবে।কিন্তু আমি তা কখনোও পারব না সুবোধ দা।সুবোধ দা,ভালবাসার পাপ কতটুকু জানি না কিন্তু ভালবাসা মানুষ কে বাচতে শিখায়,বুঝতে শিখায়।
ভালবেসে মানুষ সুখী হতে পারে না কিন্তু ভালবেসে মানুষ আত্মনির্ভরশীল হতে শিখে।
সুবোধ দা, তোমায় নিয়ে লেখা হাজার পাতার চিঠি প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে আমি একবার পড়ে ঘুমোতাম।তোমায় নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার দিন হতো,রাত হতো।
সুবোধ দা ,তোমার মত এত ভালবাসার কেয়ার কেউ করবে না।কেউ ওত অপলক চোখে তোমার মত চেয়ে থাকবে না আমার চোখে একফোঁটা ভালবাসা পাওয়ার জন্য।
সুবোধ দা,তুমি স্টুডেন্ট পড়াতে টাকার জন্য,সিগারেট কেনার টাকার জন্য কিন্তু টাকাই সবকিছু নয়।জীবন টাকার চেয়েও মূল্যবান। তাই হয়তো টাকা দিয়ে কিনে নিলে জীবন।
জানো, জীবনের সবচেয়ে পছন্দের জিনিসগুলো হয়তো অবৈধ, নয়তো নিষিদ্ধ ,নয়তো দামী, আর নয়তো সবসময়ই অন্যকারো ।
সুবোধ দা, আমি চলে যাচ্ছি আমাকে ক্ষমা করে দিও।পরজন্মে আবার হয়তো দেখা হতেও পারে।ভাল থেকো সুবোধ দা।
ইতি
অরুনা
বৃদ্ধ লোকটি নিস্তব্ধ হয়ে গেল।চোখে জল নেই;শুকিয়ে গিয়েছে।আমার চোখে জল গড়াচ্ছে ঝর্ণার মত।
কখন যে আমার চোখ লেগে গেলো তা জানিনা।বৃদ্ধ লোকটি কখন যে নেমে গেল তাও জানিনা।গাড়ি ছুটছে ধেয়ে অচিন দেশে নদী-খাল ছিড়ে।শুধু কেউ সাথে চলছে না।কেউ আর বলারও থাকেনি সুবোধ দা ,আমার জন্য আঁচার আনোনি?