সাজ্জাদুল ইসলাম শাওন
১৯৭১ সাল।চারদিকে ভয়ানক পরিবেশ। বাইরে বের হওয়ার কোনো জো নেই। পাকবাহিনীরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে। শুধুমাত্র টুপি পড়া,পাঞ্জাবি পড়া, রাজাকাররা বের হয়।তাঁরা বাঙালী মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। মুক্তিবাহিনীর যাবতীয় খবরা-খবর পাকবাহিনীর কাছে পাচার করে। এতদিনে রাজাকাররা পাকবাহিনীর সাথে বেশ একটা ভালো সর্ম্পক বাধিয়েছে।
অপরদিকে,উত্তরপাড়ার রহমত আলী সবে মাত্র বিয়ে করেছে।সে খবর কেউ জানে না, আর জানার কথাও না।কারণ দেশের যে অবস্থা, তাতে বেঁচে থাকাটাই দুষ্কর আবার বিয়ে? কিন্তু তাতে কি যৌবন কি আর থেমে থাকে?
পশ্চিমপাড়ার রহিমার সাথে রহমত আলীর বেশ একটা ভাব জমেছে। আজকাল রহমত আলী কে বাড়িতে দেখাই যায় না।রোজ পশ্চিমপাড়ার দিকে ছুটতে দেখা যায়।মাঝে মধ্যে ঝালমুড়ি, কটকটি,চুড়ি, আর ফিতা নিয়েও যেতে দেখা যায় রহমত আলী কে।
এভাবেই রহমত আলী আর রহিমার মধ্যে সম্পর্ক অনেক দুর গড়ায়।এ জগতে রহমত আলী আর রহিমার আপনজন বলতে কেউই নাই।দুজনেই একা।রহিমা ছোট বেলা থেকেই জমিলা বেগমকে খালা বলেই ডাকে আর তাঁর কাছেই থাকে। রহমত আলীর ও কেউ নেই, সে উওরপাড়ার করিম চাচার বাড়িতে রাখালের কাজ করে।

একটা সময় রহমত আলী আর রহিমার সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে করিম চাচা তাদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।তারপর তিনি ফজলু মিয়াকে বিয়ের আয়োজন করতে বলে।ফজলু মিয়া হচ্ছে করিম চাচার ছোট ছেলে। ফজলু মিয়া জমিলা খালাকে রহমত আলী আর রহিমার সম্পর্কের কথা বুঝিয়ে বলে। জমিলা খালাও এ প্রস্তাবে রাজি হয়।
তখন দেশের অবস্থা ভালো না তাই লোক জানাজানি হওয়ার আগেই করিম চাচা,জমিলা খালা, আর ফজলু মিয়া উপস্থিত থেকে কদমতলী নামক এক গ্রামে নিয়ে গিয়ে রহমত আলী আর রহিমার বিয়ে দেয়।কদমতলী গ্রামে থাকতো জমিলা খালার সতিনের মেয়ে।মুলত তাঁর বাড়িতেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।
কদমতলী গ্রামে এখানো পাকবাহিনী ক্যাম্প করেনি। শুধুমাত্র কদমতলী গ্রামেই বাকি আছে তাছাড়া সব জায়গায় পাকবাহিনী ক্যাম্প করেছে।
করিম চাচা,জমিলা খালা,আর ফজলু মিয়ার ও আর বাড়ি ফেরা হলো না। তাঁরাও রহমত আলী আর রহিমার সাথে কদমতলী গ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
কারণ,অলরেডি পাকবাহিনী তাঁদের গ্রাম ঘেরাও করে ফেলেছে। এখন চাইলেও আর ফেরা সম্ভব নয়।
জমিলা খালার সতিনের মেয়ে তাদের সবার জন্য থাকার ব্যবস্থা করে।
দু’দিন পর খবর এলো পাকবাহিনীরা কদমতলী গ্রামকেও ঘেরাও করার জন্য আসছে।সবাই ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। পালানোর পথ নেই, চারদিকে পাকবাহিনী।এমন সময় খবর এলো যুদ্ধে যেতে হবে।করিম চাচা আর ফজলু মিয়া ছুটে আসে রহমত আলীর ঘরে।তাঁরা এসে জানায় বঙ্গবন্ধু র্নিদেশ দিয়েছে আজ রাতেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে।তাই সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে রহমত আলী কোনো দিন দেখে নি,কিন্তু রেডিওতে অনেকবার তাঁর ভাষণ শুনেছে। নতুন বউ ছেড়ে রহমত আলীর যুদ্ধে যেতে যদিও খারাপ লাগছে,কিন্তু কি আর করার,যুদ্ধে যেতেই হবে। বাঁচতে হলে যুদ্ধের কোনো বিকল্প নেই।

রহিমাও রহমত আলীকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেয়।তাই দেরি না করে রহিমাকে জমিলা খালার কাছে রেখে রহমত আলী যুদ্ধে চলে যায়।রহিমা অপেক্ষায় থাকে রহমত আলীর।দিন যায়,মাস যায়,যুদ্ধও শেষ হয় না,রহমত আলীও আসে না। দেখতে দেখতে প্রায় নয় মাস, যুদ্ধ চলছে।যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রহমত আলীর ও অনেকবার রহিমার কথা মনে পড়েছে। কিন্তু কি আর করার যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফেরার কোনো পথ নেই।
রহমত আলীর কাছে কিছু টাকা ছিল। সেই টাকা দিয়ে রহিমার জন্য কতগুলো নীল চুড়ি কিনে র্শাটের বুক পকেটে রাখে আর মনে মনে ভাবে যুদ্ধ শেষ হলে বাড়ি ফিরে রহিমাকে চুড়িগুলো দিবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। গোলাগুলি চলছে তুমুল গোলাগুলি! পাকবাহিনীর আক্রমণ উল্টো মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর একটি বুলেট এসে লাগে রহমত আলীর বুকে সঙ্গে সঙ্গে রহমত আলী মাটিতে পরে যায়।রহমত আলীর পকেটে থাকা নীল চুড়ি রক্তে লাল হয়ে যায়।রহমত আলী হাত ইশারায় ডাকে ফজলু মিয়াকে।পকেট থেকে বের করে দেয় রহমত আলীর রক্তে লাল হওয়া নীল চুড়িগুলো। আর আস্তে আস্তে বলে এই চুড়িগুলো রহিমাকে দিও।এই বলে রহমত আলী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
দীর্ঘ নয় মাস পর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হলো।চারিদিকে বিজয়ের উল্লাস! বাংলার আকাশে বাতাসে বিজয়ের হাওয়া বইছে। যুদ্ধ শেষে করিম চাচা,ফজলু মিয়া সবাই ফিরলো।কিন্তু রহমত আলী আর ফিরলো না!ফিরলো শুধু রহিমার জন্য কেনা রহমত আলীর রক্তে রঞ্জিত লাল চুড়ি।