একটি দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বাস্তব চিত্র সম্পর্কে জানতে হলে দেশটির হাতে মজুত থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বানিজ্যিক ভারসাম্য (আমদানি-রপ্তানি) কোন পর্যায়ে রয়েছে তা প্রথমেই বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশেষ করে উন্নয়শীল এবং স্বপ্ল আয়ের দেশের ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি বেশি মাত্রায় হলে তা কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারের রিজার্ভ থাকাটা যে কতটা জরুরী ও মূল্যবান তা কিন্তু ২০২২ সালের চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, গত ২৮শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৩৩.৮৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অবশ্য গত নভেম্বর মাস শেষে রিজার্ভ ছিল ৩৩.৭৯ বিলিয়ন দোলার অথচ ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশের ফরেন এক্সচ্যেঞ্জ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬.০৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি ২০২২ সালের ১২ মাসে মোট ১২.২৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে কমে গেছে। যা কিনা স্বল্প আয়ের একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য মোটেও কোন সুখবর হতে পারে না। অথচ গত ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ছিল কিনা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
তবে এ মুহুর্তে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্নের রিজার্ভ রয়েছে ভারতের কাছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২২ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে ভারতের হাতে ফরেক্স রিজার্ভের পরিমাণ গত এক বছরে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হ্রাস পেয়ে ৫৬৩.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। অথচ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের কাছে ৬৪২.৪৫ বিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভের বিশাল মজুত ছিল।
তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানে ফরেক্স রিজার্ভের পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে আশাঙ্খাজনক হারে হ্রাস পেয়ে তলানীতে এসে ঠেকেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বেরের হিসেব অনুযায়ী সেন্ট্রাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এসপিবি) এর হাতে থাকা নেট ফরেক্স রিজার্ভ ছিল ৫.৮২ বিলিয়ন ডলার দেশটির অন্যান্য বানিজ্যিক ব্যাংকের হাতে নেট ফরেক্স রিজার্ভ ছিল ৫.৮৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে পাকিস্তানের হাতে মোট লিকুইড ফরেক্স রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১.৭০৭ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ফরেক্স রিজার্ভের দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে শ্রীলংকা। চলতি ২০২২ সালের অক্টোবর মাস শেষে শ্রীলংকার হাতে মাত্র ১.৯ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল। যা কিন্তু কোন ভাবেই দেশটির সার্বিক আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাছাড়া গত নভেম্বর মাস শেষে নেপালের ৮.৪ বিলিয়ন ডলার, ভুটানের ৯৭০ মিলিয়ন ডলার (জুলাই ২০২২) এবং মালদ্বীপের কাছে ৫৯৫.৬ মিলিয়ন ডলারের ফরেক্স রিজার্ভ রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রথম স্থান ধরে রেখেছে উদীয়মান অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি রেড জায়ান চীন। চলতি ২০২২ সালের নভেম্বর মাস শেষে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩.১১৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যেখানে গত ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.২১৮ ট্রিলিয়ন ডলার।
তাছাড়া সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে এশিয়ার আরেক ইকনোমিক জায়ান্ট জাপানের নাম সবার উপরে উঠে এসেছে। ২০২২ সালের ৩০শে নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী জাপানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১.২২৬ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়া বিশ্বের সর্বোচ্চ তৃতীয় বৈদেশিক মুদ্রা মজুতকারী দেশ হিসেবে ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের কাছে ২০২২ সালের ৩০শে নভেম্বরে ৮৮৫.০৬ বিলিয়ন ডলারের সুবিশাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকে। তবে একই সময়ে ইউকীপিডিয়ায় বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২৪২.৪৭ বিলিয়ন ডলার।
তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে ২০২২ সাল শেষে যুদ্ধের মধ্যেও রাশিয়ার ফরেক্স রিজার্ভ অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউকীপিডিয়ার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৩শে ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী রাশিয়ার কাছে ৫৮১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিশাল আকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেল ও গ্যাসের উচ্চ মূল্য বৃদ্ধির কারণে শত নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাশিয়ার তার অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক ও উন্নয়নশীল দেশ ভিয়েতনামের ২০২২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৮৫.৮১ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০২১ সাল শেষে দেশটির ফরেক্স রিজার্ভ ছিল ১০৯ বিলিয়ন ডলার।
তাই আজকের প্রবন্ধে উল্লেখিত প্রায় সকল উন্নয়নশীল এবং স্বল্প আয়ের দেশের অর্থনীতি ২০২২ সালে এসে মারাত্বকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে বিশেষ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা, জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি, করোনা মহামারি ও লাগামহীন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বর্তমানে বিশ্বের ৮০% দেশ কোন না কোন ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি কিংবা ভয়াবহ বিপর্যয় ও সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে একক ভাবে কোন দেশের অর্থনৈতিক নীতি বা কার্যকলাপকে সরাসরি দোষারোপ বা সমালোচনা করার আসলে কোন সুযোগ থাকে না।
লেখক :
সিরাজুর রহমান, সহকারী শিক্ষক এবং লেখক।