মাওলানা ইব্রাহিম খলিলমাহমুদী
অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাল্লাল্লাহু
মহানুভব বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিষ্ঠিত মদিনা় কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল একটি মৌলিক ও নাগরিক অধিকার পূর্ণ সাম্যের সমাজ।
মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রদর্শিত জীবন ব্যবস্থার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে গান্ধীজী বলেছিলেন “প্রাচ্য যখন অন্ধকার অতলে নিমজ্জিত ছিল প্রাচ্যের আকাশে তখন উদয় হল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং যা সারা পৃথিবী কে আলো ও স্বস্তি দান করলেন। ইসলাম কোন মানুষের বানানো মিথ্যা ধর্ম নয়,তাই সর্বোচ্চ শ্রাদ্ধার সঙ্গে সকল ধর্ম অনুসারিদেরকে তা অধ্যায়ন করার জন্য অনুরোধ করছি কোন ব্যক্তিকে দেখে নয়, ইসলামের মূল গ্রন্থ পবিত্র কোরআন পড়ে দেখুন, তাহলে আমাদের মতই অন্যরাও একে অপরকে ভালবাসবে”। ইসলাম একমাত্র জীবন ব্যবস্থা যার সারাবিশ্বকে এক সমাজ গড়ে তোলার মতো ঔদার্য ও রীতি নীতি আছে।
এ ধর্ম মতে আহলে কিতাব মুসলমান ও একই রাষ্ট্রে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মাঝে সামাজিকতার ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য নেই। মহান আল্লাহ মনোনীত কিছু খাবার ছাড়া আর অন্য সকল খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে আহলে কিতাব ও অন্যান্য ধর্মানুসারিদের মধ্যেও কোন তারতম্য নেই। আর তাই একে অন্যের খাবার বৈধ পন্থায় গ্রহণ করতে পারবেন আর এক্ষেত্রে আহলে কিতাব ও মুসলমানদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। ইসলাম শুধু অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতাই দেয়নি তাদের সাথে সামাজিক অংশীদারি, সৌজন্যবোধ ও মেলামেশার সুযোগও দিয়েছে।
এমনকি আহলে কিতাব রমণীদের বিবাহ বৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ইসলাম যেহেতু পৃথক একটি ধর্ম ব্যবস্থা তাই আত্মীয়তার ঘনিষ্ঠতার স্তর ও সহযোগিতার ধরনের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছে। ইসলাম অমুসলিমদের সবক্ষেত্রে মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে তাদের যথাযথ সম্মান দিয়েছে যার বিবরণ নিম্নরূপ।
অমুসলিমদের জুলুম করা নিষেধ
বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো উপর জুলুম করা নিষেধ করেছেন যদিও সে কাফের হয় কেননা কোন মজলুম আর আল্লাহর মাঝখানে কোন পর্দা থাকে না (অর্থাৎ তার দোয়া কবুল হয়) এ প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ) বলেন”কোন অমুসলিম নাগরিকের যে অত্যাচার করল বা তার অধিকার ক্ষুন্ন করল তার সাধ্যাতীত পরিশ্রম করল বা তার অমতে তার থেকে কিছু নিয়ে নিল কেয়ামতের দিন আমি হব তার বিপক্ষে মামলা দায়েলকারী।
অমুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ঘোষণা দিয়েছেন রাসূল বলেন “তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাদের ধন-সম্পদ আমাদের ধন-সম্পদ এর মত অমুসলিমদের জানমাল মুসলমানদের নিজের জান মালের মত পবিত্র ওনিরাপত্তা যোগ্য”।
অমুসলিমদের বাকস্বাধীনতা
দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর খেলাফত কালে যখন মিশরের শাসনকর্তা হযরত আমর ইবনুল আস দায়িত্ব পালন করছিলেন ,সে সময় একদিন আলেকজান্দ্রিয়ায় খ্রীষ্টান পল্লীতে হৈ চৈ পড়ে গেল। কেউ একজন যিশুখ্রিস্টের প্রস্তর নির্মিত মূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলেছে। আর এই ঘটনা খ্রিষ্টানরা ধরে নিল যে, এটা মুসলমানের কাজ। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠলো।

ঐখানের খ্রিস্টান বিশপ অভিযোগ নিয়ে আসলেন আমর ইবনুল আস এর কাছে।আমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মূর্তিটি নতুন ভাবে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রিস্টান নেতাদের প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল অন্যরকম। তারা চাইল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মূর্তি তৈরি করে অনুরূপ ভাবে নাক ভেঙ্গে দিতে । খ্রিস্টানদের এই মতামত ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে যে তখন তাদের কতটুকু বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। আর যে নবী (সাঃ) আজীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন করেছেন,সে নবীর মূর্তি তৈরি কে মুসলমানরা কিভাবে মেনে নিতে পারে?
হযরত আমর কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রিস্টান বিশপ কে বললেন”আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে রাজি যার নাক আপনারা চান,তখন খ্রিস্টান নেতারা এ প্রস্তাব মেনে নিল এবং রাজি হল। পরদিন খ্রিস্টান ও মুসলমানগন বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো, মিশরের শাসক সেনাপতি আমর সবার সামনে হাজির হয়ে বললেন”
এ দেশ শাসনের দায়িত্ব যেহেতু আমার,তাই যে অপমান আজ আপনাদের সাথে করা হয়েছে তা আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
তাই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আপনি আমার নাসিকা ছেদ করুন”
একথা বলেই তিনি বিশপের হাতে একখানা তীক্ষ্ণ তরবারি হাতে দিলেন। উপস্থিত জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খ্রিস্টানরা স্তম্বিত চারদিকে থমথমে ভাব সেই নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করা ও যেন ভয় । সহসা সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো আর চিৎকার করে বলল আমি দোষী, সিপাহসালাহের কোন অপরাধ নেই, আমি মূর্তির নাক ভেঙ্গেছি এই দেখুন আমার হাতে সেই প্রমান। তবে এই মূর্তি ভাঙ্গার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, আসলে বিশ্বাস করুন মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। তখন সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারী নিচে নিজের নাসিকা পেতে দিল,স্তম্ভিত বিশপ,নির্বাক উপস্থিত সকলে। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল তরবারী ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন”
ধন্য সেনাপতি আর ধন্য এই বীর সৈনিক আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার মহান আদর্শ আপনাদের মত মহৎ,উদার, নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে।যিশুখ্রিস্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতেও অন্যায় হবে যদি আজ আমরা এই সত্য বলা সৈনিকের অঙ্গহানি করি,এবং সেই মহান আদর্শের নবীকে আমরা সালাম জানাই সঠিক শিক্ষায় আপনাদের শিক্ষিত করার জন্য।
অন্যধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা সেই জ্বলন্ত উদাহরণ আজও বিশ্ববাসীকে হতবাক করে।
অমুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়া,সেবা-শুশ্রূষা করা, তাদের সাধ্য মতো নফল সদকা প্রদান করা, ভাল সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামের শাশ্বত বিধান।
ইসলাম কোন ধর্মীয় উন্মাদনা বিদ্বেষ কিংবা অসহিষ্ণুতার নাম নয় বরং ইসলাম মানবতা, মনুষ্যত্ব সাম্য ও শান্তি ভালবাসার নাম। ইসলামের এই আবেদন দেশ-কাল-বর্ণ- ভাষা কিংবা গোত্রের সীমানায় আবদ্ধ নয়। এর প্রীতি সর্বজনীন ও সকলের জন্য। মানবতা যেখানে বিধ্বস্ত ইসলাম সেখানে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে কোরআনের অমিয় সূধা পান করিয়েছে অকৃপ আপনতায় বুকে টেনে নিয়ে।
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জীব এই জন্যই বেলাল এর মত নির্যাতিত কালো মানুষ গুলো দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সমবেত হয়েছিলেন যুগে যুগে কালে কালে। ধর্মের নামে সমস্ত অধর্ম আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইসলামই সর্বপ্রথম প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় এবং সকল ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে।
আমি লেখা পাঠাতে চাই