বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক ঘটনা বা অধ্যায় হচ্ছে একাত্তরের মক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে ১৬ ডিসেম্বরে। বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, তত দিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। কারণ বাঙালি জাতি জন্ম থেকেই কোনো না কোনো শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে, অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। কখনো মোগল-পাঠান, কখনো ব্রিটিশ, কখনো পাকিস্তানিদের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস মানেই শোষণ আর অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাস মানে না পাওয়ার আর বেদনার ইতিহাস। আজকের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজেদের উৎসর্গ করে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন, তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সবই নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় তারা শ্রমজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ এ দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতি কিভাবে তাদের পরাজিত করেছিল, তার যথাযথ ইতিহাস নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব ও কর্তব্য সবার।
নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু শুনেছে গল্পের আকারে তাদের পরিবারের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে, শিক্ষকের কাছে, কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছে বা বইয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সেই শোনা বা পড়া কতটুকু সঠিক বা তার বিস্তৃতি কতটুকু, তা আমরা জানি না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান কতটুকু তা-ও দেখার বিষয়। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ও শিক্ষকরা।
আমাদের অমিত সম্ভাবনার তরুণরা যদি আমাদের গৌরবময়, আত্মত্যাগে মহীয়ান, সর্বস্বত্যাগী ইতিহাসের সত্যকে হৃদয়ে পরিপালন করে তবে তারা নিজেদের কুমন্ত্রণা,মিথ্যা, অপপ্রচার,অন্যায় থেকে বিরত রেখে দেশপ্রেমী হয়ে তাদের জীবনীশক্তির বিভায় নতুন শিখা প্রজ্বলিত করে আলোকিত করবে এই দেশকে যার আলোতে পৃথিবীর নানা বঞ্চিত,নিপীড়িত, অসহায় মানুষ ও দেশ আমাদের কাছ থেকে নতুন করে দীক্ষা লাভ করে সত্য, সুন্দর, ন্যায়ের আলোকে উজ্জ্বল হবে যেমনটা আমরা ১৯৭১ সালে একবার বিস্ময়ে সারা বিশ্বকে দেখিয়েছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ একটা ঘটনা মাত্র নয় এর রয়েছে মহাকব্যিক ব্যঞ্জনা। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব দিয়েছে, ভৈাগোলিক অবস্থান দিয়েছে, আত্মপ্রত্যয়ে সুদৃঢ় হওয়ার বোধ দিয়েছে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য, দেশপ্রেমী, বাঙালী জাতীয়তায় বিশ্বাসী নতুন ও সত্য চিন্তার সমাজ গড়তে সাহায্য করতে পারে তেমনি যে রক্ত, ত্যাগ, বীরত্ব, অসীম মর্মযাতনা ব্যাপকভাবে আমাদের তরুণদের মাঝে প্রবেশ করাতে হবে; কারণ আমরা যদি নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব, হিংসা, অবিশ্বাস নিয়ে থাকি তবে ওঁৎ পেতে থাকা আমাদের নিয়ত শত্রুরা আমাদের খুব সহজেই আরও দুর্বল করে দিবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে গেলেই প্রথমেই চলে আসে ভাষা আন্দোলনের কথা, মোটা দাগ দিয়ে আলাদা করতে চাইলে বলতে হবে, নিজ ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার কথা। ভাষার দাবিতে এত মানুষ কখনো কোথাও মারা যায়নি এবং মারা যাবেও না- এই ভবিষ্যদ্বাণী চাইলেই করে ফেলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে বলতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, বাংলাদেশের প্রথম প্রণীত সংবিধানের মূল নীতিতে যার উল্লেখ আছে। বহির্বিশ্বের সংস্কৃতির আগ্রাসন যাতে নিজস্ব সংস্কৃতির জায়গা দখল করতে না পারে সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা। সাতচল্লিশের পর থেকেই বিভিন্ন সময় পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের অনেক মানুষকে বিনাবিচারে গ্রেফতার, বিনা বিচারে খুন করেছে তাদের ইচ্ছামত,নির্দোষদের শাস্তি দিয়েছে,দোষীরা থেকেছে নির্ভয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আপনি ধারণ করলে তাই আপনি চাইবেন সকল ঘাতক অপরাধীর বিচার হোক। যেমন করে এই অন্যায়ের বিচার চাইতে তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলেছিল গণজাগরণ মঞ্চ।
বর্তমান সরকারের যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সংকল্প তা করতে পারে এই নতুন প্রজন্ম; তাদের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা আর সেই সঙ্গে থাকতে হবে পরিপূর্ণ দেশপ্রেম-মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে মর্যাদা, আত্মবিশ্বাস, অহংকার, সততার শিক্ষা, মাথা উঁচু করে চলার উজ্জীবনী শক্তি, ন্যায় বলার, প্রতিবাদী হওয়ার ও দেশের জন্যে কিছু করে যাবার অধিকার দিয়েছে তা রোধ হয়ে গেলে তরুণ সমাজ দারুণভাবে নিরাশ হবে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদেরও আরেকবার যুদ্ধের প্রত্যয়ে নতুন সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা আর সত্যিকারের চিত্রটি পরিষ্কার করে তুলে ধরে নবীন চেতনাকে স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে স্বাধীনতাকে তাদের হৃদয়ে ধারণ করার মন্ত্র শিখানোর সময় শেষ হয়ে যায়নি। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে তা দেখেও আমাদের আগামী প্রজন্ম শিক্ষা গ্রহণ করবে।ইতিমধ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের অনেক কার্যক্রম দেখিয়েছেন যেমন গণজাগরণ মঞ্চ,সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তারুণ্য একটি প্রাণশক্তি, এর অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিলতায় পরিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন। তরুণদের ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার ভাবনা, তরুণ সমাজের চিন্তাভাবনা হবে বাংলাদেশকে নিয়ে। যোগ্য নেতৃত্বে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর চেতনাকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারুণ্য একটি প্রাণশক্তি, এর অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিলতায় পরিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন। তরুণদের ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার ভাবনা, তরুণসমাজের চিন্তাভাবনা হবে বাংলাদেশকে নিয়ে। তাদের অস্তিত্বে থাকবে বাংলাদেশ। নতুন প্রজন্মের মেধা, মননে ও চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার উন্মেষ যথাযতভাবে ঘটাতে হবে কারণ এরাই ভবিষ্যতের এ দেশের কান্ডারি হবে।
খোরশেদ আলম বিপ্লব
সম্পাদক
সাহিত্য পত্রিকা বাতায়ন24, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।
ঢাকা বাংলাদেশ।