সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষ হওয়ার মতো উপযুক্ত গুণাবলী নিয়ে বয়োবৃদ্ধির সাথে পরিপক্ব হয়েই তৈরী হয় সত্যিকারের মানুষ।
শুধু মাত্র চোখ কান নাক মুখ থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না যদি তার মাঝে মনুষ্যত্ব বা বিবেকবোধ না থাকে। মানবতা আর মানবোচিত সদগুনের অধিকারী কেই বলা যায় মানুষ । মানবপ্রেম,সততা,বিশ্বস্ততা,বিনয়,নম্রতা,সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, ত্যাগ এসবই মানবোচিত সদগুন । এসব কিছুর সমন্বয়েই গড়ে উঠে মনুষ্যত্ববোধ। আর মানুষকে ও তার চলার পথে এসব কিছুর চর্চা করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হলেই কেবল বড় মানুষ হবে এমন কথা নেই , কেবলমাত্র মানবিক নৈতিকতা পূর্ণ শিক্ষাই মানুষকে সৃস্টির শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় আসীন করতে পারে ।
মানুষ তার প্রকৃতি বা স্বভাবগতভাবেই যেসব কল্যানকর বৈশিষ্ট্য ও ধর্মকে লালন করে তাই মনুষ্যত্ব। মানুষকে ভালোবাসবে, অধিকার ও সন্মান দিবে এটাই মনুষ্যত্ব । একই সাথে প্রকৃতি ও জগৎ কে ভালোবাসা ও রক্ষা করা মানুষের ধর্ম। কেননা জীবকে ভালোবেসেই মিলবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি আর সান্নিধ্য ।
তাই তো স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন –
” জীবে দয়া করে যেই জন
সেইজন সেবিছে ঈশ্বর ।। “
দিনে দিনে মনুষ্যত্ব যেন বিপন্ন হতে চলেছে । প্রতিহিংসা আর লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। মায়া,প্রেম, ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে মিথ্যা অহমিকা আর নিষ্ঠুরতার আড়ালে। মুখোশের অন্তরালে নিজের নস্ট কামনাকে লুকিয়ে রেখে প্রতিনিয়ত অন্য কে ঠকিয়ে যাচ্ছে । নোংরা রাজনীতি আর ক্ষমতার দাম্ভিকতায় মত্ত্ব বিবেকহীন মানুষগুলো প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত । ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকতে তারা বরন করে অসহায় মানবতার করুন মৃত্যু । শান্তিকামী নিরীহ জনগন হয় উঠে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের পুতুল । নৃশংসতা আর বর্বরতা হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের যাপিত জীবন।
মানুষ যেমন মনুষ্যত্বকে বহন করে। তেমনি বিভিন্ন সময় মানুষই মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছে । জাতি,ধর্ম, বর্ন,সম্প্রদায়ের নামে মানুষকে বিভক্ত করা হচ্ছে । মেয়ে শিশু হত্যাসহ নানা অমানবিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আরবদেশে মনুষ্যত্ব ভুলুন্ঠিত হয়েছে। ইউরোপের দেশ সমুহে মনুষ্যত্বের বিপর্যয়ে পেশীশক্তির উত্থান ও ধর্মের নামে অধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নিধনযজ্ঞ ও পারমানবিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে বিসর্জিত হয়েছিল মানবতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নির্বিচারে হত্যা করেছিল ৩০ লক্ষ তাজা প্রান,কেড়ে নিয়েছিল অসংখ্য মা বোনের সম্ভ্রম, চালিয়ে ছিল ধ্বংসযজ্ঞ, করেছিল মনুষ্যত্বের অবমাননা । সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাখাইন সম্প্রদায়ের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশছাড়া করেছে যা ইতিহাসের জঘন্যতম মনুষ্যত্বহীন কাজ । অতি সম্প্রতি বিশ্বের ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারস্য উপসাগরের তেল সমৃদ্ধ দেশ ইরানের ক্ষমতা আর স্বার্থের সংকটের জেরে প্রান গেল বেশ কিছু নিরীহ মানুষের,যা মনুষ্যত্ববোধের চরম অবমাননা । এভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে মনুষ্যত্বের দাফন ।
এ তো গেল সমষ্টিগত মানবতা হরন,ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্বে আর পার্থিব লোভের শিকার হয়ে ও হরহামেশাই ঝরে যায় কত অকাল প্রান,সে হিসাব কে রাখে ?
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও ঔপন্যাসিক স্যার উইলিয়াম গোল্ডিং বলেছেন –
” মানুষের আদিমতা ও হিংস্রতা সহজাত,সেরকম বুনো পরিবেশ পেলে মানুষ তার সভ্যতার লেবাস খুলে হিংস্র হয়ে উঠে ।”
আমাদের সমাজের মানুষের নৈতিক শিক্ষার অভাবে মুল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় শুরু হয়েছে । তাই
মানব জীবনে ও মানব কল্যানে মনুষ্যত্ব বোধের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন অপরিহার্য । আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহ্যগত উন্নয়ন আমাদের মানবতা তথা মনুষ্যত্ব বোধের উপর নির্ভর করে, তাই আমাদের মনুষ্যত্ব বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। যদিও কখনো ধর্মান্ধতা বা উগ্র সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবতা বা মনুষ্যত্ব বোধের বিপর্যয় ঘটে , তাই শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার তথা সমাজ,মসজিদ, মন্দির,গীর্জা সর্বত্র নৈতিকতা ও মানবতার শিক্ষা দিতে হবে এবং সচেতন করতে হবে।
তাহলে নতুন প্রজন্ম মানবতা ও মনুষ্যত্ব বোধের চর্চায় অনুরাগী হবে। মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি দায়িত্ব,কর্তব্য ও তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলেই মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত হবে আর এর মধ্যেই নিহিত আছে মানবজীবন, প্রকৃতি ও জীবজগতের উৎকর্ষতা ।
আত্মোপলব্ধি থেকে,
উম্মে কুলসুম মুন্নি
আইনজীবি।