আজম পাটোয়ারী
আমার খুব কাছের বন্ধু রাজনের মুখে শোনা কথা এটি, আজ আমি তা আপনাদের কাছে বলব।
শীত কাল ভেজা শিশিরে সিক্ত পথ-ঘাট কুয়াশার চাদরে মোড়ানো।
আমার এক দুঃসম্পর্কের বুড়ো দাদু মারা গেছে।আমরা তার শব দ্বাহ করার জন্য চিতায় নিয়ে যাচ্ছি,আমাদের বাড়ি থেকে চিতায় যেতে হলে নদী পাড় হয়ে যেতে হয়। আমরা শব নিয়ে আত্নীয় স্বজন সবাই নদীর পারে দাড়িয়ে আছি,বাড়ির মহিলারা সবাই কান্নাকাটি করছে একটু দূরে। মাঝি পুরোহিত আর আমরা পরিবারে লোকজন। তখন রাত বেশ হয়ে গেছে, প্রায় ১২টার উপরে বাজে। একে তো কুয়াশায় ঢাকা কনকনে শীত তার উপর মাঝরাত।
আবার কি না শবদ্বাহ করতে হবে এই সময়,অত্যাগ না গিয়েও উপায় নেই দুঃসম্পর্কের হলে কি হবে আপনের চেয়েও বেশি, তাই যেতেই হবে। সেই সকালের মারা গেছে ,তাই রাখাও যাবে না আগামি দিন পর্যন্ত আর তাই সবার কথা মত আজকেই পোড়া দিতে হবে।
যদিও কারো কারো মত ছিল তার এক ছেলে এখন শহর থেকে এসে বাড়ি পৌছায়নি, তবুও কিছু করার নেই, সারা দিন তো দেখা হল। তাই এখন শ্বশানে যেতে হবে দ্বাহ করার জন্য তা আবার নদী ওপারে, আর এটা ছাড়া কোন কাছে পিঠে শ্বশানঘাটও নেই এটাই আমাদের গ্রামের একমাত্র শ্বশানঘাট,আর যেতে হবে একেবারে নদী পাড় হয়ে।
অন্য কোন উপায় নাই নৌকা ছাড়া। আত্নীয় স্বজন সবাই লাশের উপর কান্নাকাটি করছে কিন্তু লাশ বলে কথা,তাই কেউ আবার তাড়া দিচ্ছে আপনারা তাড়াতাড়ি করেন। রাত অনেক হয়েছে তার উপর আবার আজ ভাল শীত পরছে। নৌকায় উঠার জন্য মাঝিও তাড়া দেয়।
অবশেষে সবার কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে লাশ তোলা হল নৌকাতে। লাশ বহনের জন্য এখানে নৌকাটা অনেক বড় করে তৈরি করা তারপরও সবাই গেল না। নৌকায় উঠল মৃতের তিন উপস্থিত ছেলে ,আমি আর এক চাচাত ভাই ও ছেলের নাতিরা দুইজন এবং বুড়ো পুরোহিত।
নৌকা চলছে ছলাৎ ছলাৎ বৈঠার তালে। শবের পাশে পুরোহিত আর দাদার সেজ ছেলে বসা ছিল। তারা দু’জন ছিল এক পাশে আর অন্যরা মাঝির পাশে কেউ ও নৌকার সামনের দিকে বাকিরা বসা ছিল। দাদার সেজ ছেলে সে একটু কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করছিল। বাবার লাশটার দিকে তাকাচ্ছিল আর কেমন একটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিলো, লাশের পাশে সে আর থাকতে পারছে না। তাই সে সামনের দিকে সবার সাথে গিয়ে বসলো।
পুরোহিতকে সেখানে থাকতে বললে তিনি তাতে আপত্তি করলেন না। নৌকা সামনে এগুচ্ছে,ঠাণ্ডায় সবাই জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। নদী পাড় হতে একটু সময় লাগছে কারন নদীতে কচুরিপানা জটলা বেধে আছে। সবাই চুপচাপ বসে ছিল, পিন পতন নিস্তব্ধতা চারদিকে। হঠাৎ কেমন জানি জপাৎ করে একটা শব্দে সবার আড়মোড়া ভেঙ্গে গেল। মনে হচ্ছিল যেন কোন কিছু ভেঙ্গে গেছে তারপর পানিতে আছাড়ে পড়েছে। সবাই কিছুটা বিরক্ত আর কেন জানি অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
কিন্তু একটা অজানা ভয় মনের মধ্যে কাজ করতে থাকে। টর্চ দিয়ে পানিতে আলো ফেলা হল কিন্তু না কিছুই দেখা গেল না। সবাই মনে করল নৌকার আশেপাশে বা নৌকাতে কোন কিছু ভাঙ্গল কিনা বা কোথাও ফুটা হল কিনা আলো ফেলে দেখা শুরু করলো। কিন্তু না কিছুই পাওয়া গেল না। এরপর আবার নৌকার পাশে গেল পুরোহিতের দিকে আলো ফেলেই চক্ষু তো চরকগাছা। যা দেখলো সবাই তা নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারল না। একি পুরোহিত মশাই কই? তার কোন অস্তিত্তই নেই নৌকাতে, রীতিমত উধাও হয়ে যাওয়া বলতে যা বুঝায়।
তারপর একটা চিৎকার করে মেঝ কাকু অজ্ঞান হয়ে গেল। মাঝির হাত থেকেও দেখি বৈঠাটা পড়ে গেছে এতক্ষনে তার হাত পা কেমন ভয়ে কাপছে, নৌকাটা দিকবিদিক ঘুরতে লাগলো। নৌকার সবাই তারা বজ্রাহতের মত দাড়িয়ে রইল বাঁকরুদ্ধ হয়ে। তারপর আবার সামনে আলো ফেলতেই তারা দেখে।পুরোহিত মশাই তো নাই আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল লাশের অর্ধেক অংশ নাই, আর তার পাশে রক্তের ছড়াছড়ি। সবাই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেল একদৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। আর নদীর মাঝখানে নৌকাটি তখন শুধু ঘুরতে লাগলো।
এখন কি করা উচিত কেউ যেন কিছু ভেবে পাচ্ছে না, তারপর আমি ডাক দিলাম কি আপনারা এভাবে দাড়িয়ে আছেন কেন শব দ্বাহ করা লাগবে না।
তারপর মাঝির যেন হুশ ফিরল সে কোন রকমে আরেকটা বৈঠা দিয়ে নৌকাটা পাড়ের দিকে নিতে লাগলো।
কোন রকমে সবাই মিলে সেদিন শব দ্বাহ করে দ্রুত বাড়ি ফিরে এলাম।
এরপর আমি আর কোন দিন ঐমুখো হইনি।
আর গ্রামের কেউ মারা গেলে, যতদূর সম্ভব দিনের বেলায় দ্বাহ করে ফেলা হয়।
কিন্তু ঐ দিন রাতে কি হয়েছিল তা ঠিক বুজতে পারলাম না,আজও ভয় হয় তা মনে করে।
সমাপ্ত।