“তুমি কাঁদছো কেন বুড়িমা?
অবলম্বন কি তোমার কেউ নেই?
সারাদিন ভিক্ষা করে পেট কি ভরে?”
– সেদিন স্কুলের হাঁটা পথ দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল অমল। কিছুটা দূরে একটা বটবৃক্ষের তলায় এক বৃদ্ধা ভিখারী বুড়িমা, বসে বসে কাঁদছে। অমলের এই দৃশ্যটি চোখে পড়লো,সে বৃদ্ধা ভিখারী বুড়িমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে বুড়িমা,তুমি কাঁদছো কেন?”
– বৃদ্ধা বুড়িমা অমলকে দেখে বললো “বাছা বয়েস হয়েছে,আগের মতো আর চলাফেরা করতে পারিনা। দু-দিন পেটে কিছু খাবার জোটেনি বাবা!”
কথাটা শুনে অমলের খুব মায়া হলো, সে স্কুলের ব্যাগ থেকে মায়ের হাতের তৈরি খাবারের টিফিন বক্সটা বুড়িমার হাতে দিয়ে বললো, বুড়িমা খাবারটা খাও।
বৃদ্ধা ভিখারী বুড়িমা বললো “বাছা এ খাবার আমি একা খেলে, টিফিনের সময় তোকে ও না খেয়ে থাকতে হবে বাছা।”
আমল প্রথমে একটু হাসলো, না না বুড়িমা আমি বাড়ি থেকে খেয়ে আসি,মা জোর করে খাবার দিয়ে দেয়। আমার খিদে লাগেনা বুড়িমা,আপনি পেট পুরে খান। ওই স্কুলের ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজলো, বুড়িমা স্কুলে যেতে হবে, বেশি দেরি হলে হেড-স্যারের কাছে বকুনি খেতে হবে।”
অমল টিফিন বক্সের খাবারটা বুড়িমার হাতে দিয়ে, টিফিন বক্স ব্যাগে রেখে টানা দৌড় মারলো স্কুলের পথে।
এইভাবে অমল প্রতিদিন বাড়ি থেকে মায়ের হাতে খাবার আনে, সেই খাবার বৃদ্ধা বুড়িমার হাতে তুলে দেয়। এইভাবে প্রায় একমাস চলার পর অমল প্রায় স্কুলে একটু দেরি করে ঢোকে।
স্কুলের হেডমাষ্টার মশাই অমলের মা ও বাবার কাছে নোটিশ পাঠায়,”তার ছেলে প্রায় এই একমাস ধরে স্কুলে দেরিতে ঢুকছে!”
অমলের মা সেদিন প্রচন্ড রেগে আছে। আসুক ছেলে স্কুল থেকে “কোথায় যায় ও? বড্ড বাঁদরামো বেড়েছে!”
সেদিন অমল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই, অমলের মা অমলকে জিজ্ঞাসা করলো “তুই স্কুল থেকে কোথায় যাস, একমাস ধরে কোথায় যাচ্ছিস তুই? স্কুলের টাইমে পৌঁছাতে পারিস না!”
অমল সেদিন চুপ বাবা ও মায়ের প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না সে। কারন অমলের মা যদি জানতে পারে তার টিফিনের খাবার সে প্রতিদিন বৃদ্ধা বুড়িমাকে দিয়ে আসে। এটা জানতে পারলে তার রক্ষে থাকবে না। সেদিন মা ও বাবার প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি অমল। মায়ের হাতে অনেক মারও খেলো সে।
অমলের মা ও বাবা ছেলে এই আচরণে ভীষণ অবাক হলো, “যে ছেলে কোন সমস্যার কথা মা ও বাবা কে ছাড়া বলে না, সেই ছেলে আজ মুখে কুলু পেতেছে।”
– অমলের মা ও বাবা অবাক হলেন সেদিন। একদিন অমলের মা ও বাবা স্কুলের হেডমাষ্টার মশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
প্রধান শিক্ষক মশাই বললেন, “আমার মনে হয়, অমল যখন স্কুলে আসছে সেই সময় আপনারা গোপনে নজর রাখুন ও কোথায় যায়! তাহলেই এর একটা সমাধান পাওয়া যাবে।”
– পরদিন অমলের বাবা ও মা ঠিক করেছে ছেলে যখন স্কুলে বেরিয়ে যাবে, তখন ছেলের পেছনে পেছনে তার মা ও বাবা ধাওয়া করবে, “অমল কোথায় যায়?”
সেদিন অমল টিফিনের বক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে স্কুলের পথে রওনা দিলো।
এদিকে পেছনে তার মা ও বাবা,”ওই অমল এগিয়ে যাচ্ছে,দেখো রাস্তার এক কোনে অমল বাঁক নিলো,হঠাৎ একটা বটবৃক্ষের কাছে দাঁড়িয়ে।”
সেদিন অমলের মা ও বাবা গোপনে যা দৃশ্য দেখলো ছেলের জন্য সত্যি তাদের গর্ববোধ হচ্ছে।
অমলের মা বলে, “আমার ছেলেটা এতো মার খেয়েও বললো না এই সত্য কথাটা।”
সেদিন অমলের মা ও বাবা বৃদ্ধা বুড়িমার কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো।
বৃদ্ধা বুড়িমার কাছে অমলের মানবিকতার কথা শুনে অমলের মা অমলকে জড়িয়ে ধরে,ছেলে কে অনেক আদর করে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক এই পরিস্থিতির কথা জানতে পেরে সেখানে আসেন এবং অমলের এই কাজে তিনি সত্যি গর্বিত। এই কথা জানতে পেরে স্কুলের ছেলে-মেয়ে, শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলে সেখানে হাজির হয়। সেদিন অমল বললো, “আমরা এখনো মানুষ হতে পারিনি স্যার? এই রকম হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ “বৃদ্ধা বুড়িমা” না খেতে পেয়ে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে এ দোর থেকে ও দোরে ঘুরে বেড়ায়। যে মা ছেলেবেলা থেকে লালিত-পালিত করে মানুষ করলো। আজ তার দু’মুঠো অন্য জোটে না। এই বৃদ্ধা বুড়িমার চোখের জল আমি সহ্য করতে পারতাম না মা!”
অমলের মা-বাবা, ছাত্র-ছাত্রী,সহপাঠী,শিক্ষক-শিক্ষিকা মন্ডলী সকলে অমলের এই কথা শুনে হাততালি দিলো।
অমলের মা বললো, “আজ থেকে এই বৃদ্ধা বুড়িমা আমাদের বাড়িতে থাকবে।”
সেদিন অমল তার মা ও বাবার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি হাসলো।