বাতায়ন24 ডেক্স
এ যেন গান নয় যেন বাংলার ইতিহাসের প্রকাশ ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’ এই গানে শুনেনি আর পছন্দ করে না এমন বাঙ্গালী খুজে পাওয়া যাবে না, এই গানের সুর শুনে আমাদের বিজয়ের মাসে দিনটি শুরু হয়। দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে আমরা আরো শুনি ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না‘,
‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’ এমন কালজয়ী গানগুলো।
অথচ বেশির ভাগ মানুষ জানেনই না উপরের তিনটি গানের জীবন্ত রুপদানকারীর নাম। অমর এই গানগুলো লিখেছেন গীতিকবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবু।
বাঙ্গালী জীবনে ২১ ফেব্রুয়ারি,২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় থেকে স্থানীয় যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এ গানগুলো ছাড়া যেন পূর্ণতা পায় না। অথচ তার মতো প্রতিভাধর ও কালজয়ী গীতিকবির কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও মিলেনি। তিনি ভারতে ট্রেনিং শেষে করে দেশে ফিরে স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে অংশগ্রহণ করেন এবং কলম ও অস্ত্র দু’টোই সমান দক্ষতায় চালান দেশের জন্য।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে তুরার পাহাড়ে যুদ্ধের সময় সুযোগ মত দেশমাতৃকার গান লিখতেন।

গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার চরনগর গ্রামের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিকভিটা একই উপজেলার হেমড়াবাড়ি গ্রামে। পিতা বজলুল কাদের ও মাতা রেজিয়া বেগম। পিতা বজলুল কাদেরের সঙ্গীতানুরাগ ছোটবেলা থেকেই বড় সন্তান নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে।
১৯৭১ সালে তিনি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার লেখাপড়া, সাহিত্য ও সংগীত চর্চা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালেই তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে গীতিকার হিসাবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর একে একে লিখতে থাকেন দারুণ সব গান।
যার মধ্যে রয়েছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ এবং
‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ অন্যতম কালজয়ী সব গান।
‘সবকটা জানালা খুলে দাওনা’ গানটি তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর এবং বিভিন্ন সৃজনশীল অনুষ্ঠানের সূচনা সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হতে।
পরবর্তীতে এই গানটি দেশবরেণ্য প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ ১৯৯২ সালে তার পরিচালিত ‘সিপাহী’ ছবির টাইটেলেও ব্যবহার করেছিলেন।
এই গানটি ছাড়াও নজরুল ইসলাম বাবু’র লেখা অন্যান্য দেশাত্মবোধক গানগুলো আজো বিভিন্ন জাতীয় দিবসে গাওয়া হয়।

কণ্ঠশিল্পী দিলরুবা খানের কণ্ঠের ঝড় তোলা ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল’ গানটিও নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা। তিনি বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদের প্রথম কার্যনির্বাহী পরিষদ (১৯৭৮-৭৯) এর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭৮ সালে সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাথে তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে গান লিখতে শুরু করেন। চলচ্চিত্রে নজরুল ইসলাম বাবুকে আমরা পেয়েছি ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘মহানায়ক’, ‘প্রতিরোধ’, ‘উসিলা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘প্রেমের প্রতিদান’-এর মতো দারুণ সব চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় সব গানে। শুধু বাংলাদেশের সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সুবীর নন্দী, অ্যান্ড্রু কিশোরের মতো শিল্পীরা নয়;
বরং ওপাড় বাংলার নামি দামি শিল্পীরাও বাদ যাননি তার গানের সুর থেকে।
কুমার শানু, আশা ভোঁসলে, হৈমন্তী শুক্লার মতো উপমহাদেশের জনপ্রিয় ও কিংবদন্তীতুল্য শিল্পীরাও নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা গান গেয়েছেন।
স্ত্রী ও দুই মেয়েসহ বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ভক্তবৃন্দকে কাঁদিয়ে ১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অকালে পরপারে পাড়ি জমান বাংলা গানের মেধাবী ও অসাধারণ গীতিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবু।
আমাদের আজকের তরুন প্রজন্ম এমন একজন গীতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানে না কিংবা আমরা সর্বাধুনিক হয়েও তা সবাই কে জানাতে পারেনি। অথচ তাঁর লেখা গান আজও দেশসেরা কণ্ঠগুলো গেয়ে থাকেন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর স্মৃতি হয়ত এখনো এদেশের প্রবীণ শিল্পী, সুরকারদের অন্তরে মিশ্রিত আছে।
তিনি যে গানের বাণী রেখে গেছেন এ ভুবনে, ভুলিবো তা কেমনে। তাই মহান আল্লাহ্ নিকট আরজ দোয়া করি,তিনি যেন নজরুল ইসলাম বাবুকে ক্ষমা করে কবূল করে নেন এবং ওনার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এই বিজয়ের মাসে।