বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
(৫৭০-৬৩২ খ্রি.)
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন –
‘তিনি নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত, যদিও তারা ছিল ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট’।..সূরা জুম‘আ
আয়াত ২
সর্ব কালের সর্বশ্রষ্ঠ মহা মানব হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কর্মময় জীবন আলোচনায় দেখা যায়,মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, মহত্ত্ব, ধৈর্য্য, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, আমানতদারি, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্য নিষ্ঠা যার চরিত্রের ভূষণ।
যিনি ছিলেন একাধারে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে স্ত্রীদের কাছে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত; যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সমাজ সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, মহৎ ও সফল রাজনীতিবিদ তিনি হলেন রহমতাল্লিল আলামিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)।
তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল,আর তাই সে যুগকে বলা হত আইয়েমে জাহিলিয়াতের বা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্ম :
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার সুবেহে সাদিকের সময় আরবের মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে পিতা আবদুল্লাহ এর ঘরে মাতা আমেনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত মুহাম্মাদ(সা.) জন্মের বছরেই হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটে এবং সে সময় সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহনের ৪০ বছর পূর্তি ছিল এ নিয়ে কারো মাঝে দ্বিমত নেই। জন্মের ৫ মাস পূর্বে পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আরবের তৎকালীন অভিজাত পরিবারের প্রথানুযায়ী তাঁর লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বনী সা’দ গোত্রের বিবি হালিমার ওপর।
এ সময় বিবি হালিমার আরেক পুত্রসন্তান ছিল, যার দুধ পানের সময় তখনো শেষ হয়নি। বিবি হালিমা বর্ণনা করেন ‘শিশু মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আমার ডান স্তনের দুধ পান করত। আমি তাঁকে আমার বাম স্তনের দুধ দান করতে চাইলেও, তিনি কখনো বাম স্তন হতে দুধ পান করতেন না।’ আমার বাম স্তনের দুধ তিনি তাঁর অপর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন।আর দুধ পানের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর এই নিয়ম বিদ্যমান ছিল। ইনসাফ ও সাম্যের মহান আদর্শ তিনি শিশুকালেই দেখিয়ে দিয়েছেন।
মাত্র ৫ বছর তিনি ধাত্রী মা হালিমার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এরপর ফিরে আসেন মা আমেনার গৃহে। ৬ বছর বয়সে তিনি মা আমেনার সাথে পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা যান এবং মদিনা থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ‘আবওয়া’নামক স্থানে মা আমেনা ইন্তেকাল করেন।
এরপর ইয়াতিম মুহাম্মাদ (সাঃ) এর লালন-পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্রমান্বয়ে দাদা আবদুল মোত্তালিব ও দাদার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিবের ওপর। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ যে মহামানব আবির্ভূত হয়েছেন সারা জাহানের রহমত স্বরুপ; তিনি হলেন আজন্ম ইয়াতিম এবং দুঃখ-বেদনার মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে ওঠেন সত্যবাদী,পরোপকারী এবং আমানতদারি হিসেবে।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শৈশব ও কৈশোর কাল :
ঐ সময়ে আরবের রীতি ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এই রীতি অনুসারে মুহাম্মাদ(সাঃ) কে হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) হাতে দিয়ে দেয়া হয়।
এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য–শিশু মুহাম্মাদ কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মুহাম্মাদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মাদকে আবার মা হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে আর এতে তার মনের আশা পূর্ণ হল।
হালিমার ঘরে থাকা অবস্থা একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে – একদিন শিশু নবীর মাঠে খেলা করার সময় তার বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে এবং তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।
এই ঘটনার পর আবার মা হালিমা মুহাম্মাদকে তার মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এসময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। মা আমিনা শিশু মুহাম্মাদ, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে সাথে নিয়ে মরুপথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন এবং মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন।
একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে এসে মা আমিনা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালেব শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মাদের দেখাশোনা করতে থাকেন। মুহাম্মাদের বয়স যখন ৮ বছর তখন তার দাদা মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে আদরের নাতি শিশু মুহাম্মাদের দায়িত্ব দিয়ে যান।
আবু তালিব পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে তারা একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদ(সাঃ) এর বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। পিতৃ-মাতৃ হারা শিশু ভাতিজার পরম মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না।
যাত্রাপথে তারা যখন বসরা পৌঁছালেন পরে কাফেলাসহ আবু তালিব সেখানে তাঁবু ফেললেন। সেই সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন।
এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং আবু তালিব কে সতর্ক করেন তাকে নিয়ে যাতে দেশে ফিরে যায়।
ফিজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তার অন্তর ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং এসব হিংস্রতা থেকে পরিত্রানের পথ খুজতেন।

নবুয়ত এর পূর্ব জীবন :
আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা,মারামারি, আমানতের খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্য তখন হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়।আর যুবক মুহাম্মাদ (সা:) এতে যোগদান করেন এবং এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখেন। জানা যায় যে তরুণ বয়সে মুহাম্মাদ(সা:) এর তেমন কোন নির্দিষ্ট পেশা ছিলনা।
তবে তিনি বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা’দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন।
এরপর তিনি ব্যবসায় শুরু করেন এবং মুহাম্মাদ(সা:) অল্প সময়ের মধ্যেই এই কাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এতই খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে তার উপাধি হয়ে যায় আল আমিন এবং আল সাদিক যেগুলোর বাংলা অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে সত্যবাদী এবং বিশ্বস্ত। ব্যবসায় উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মাদ (সা:) এর সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন বিবি খাদিজা তা অবহিত হয়ে তাকে নিজের ব্যবসার দায়িত্ব নিয়ে সফরে যাবার অনুরোধ জানান। মুহাম্মাদ(সা:) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদিজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।
খাদিজা মাইসারার মুখে মুহাম্মাদ(সাঃ) এর সততা ও ন্যায়পরায়নতার ভূয়সী প্রশংসা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদ(সাঃ) কে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ(সাঃ) বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। মুহাম্মাদ(সাঃ) তাঁর চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
বিয়ের সময় বিবি খাদিজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদ(সাঃ) এর বয়স ছিল ২৫ বছর। বিবি খাদিজা(রাঃ) জীবদ্দশায় তিনি আর কোন বিয়ে করেননি। বিবি খাদিজার(রাঃ) গর্ভে মুহাম্মাদ(সাঃ) এর ৬ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে যার মধ্যে ৪ জন মেয়ে এবং ২ জন ছেলে। তাদের নাম যথাক্রমে কাসেম, যয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম’, ফাতিমা এবং আবদুল্লাহ। এবং ছেলেরা দু’জনই শৈশবে মারা যায়। মেয়েদের মধ্যে সবাই ইসলামী যুগ পায় এবং একমাত্র ফাতিমা ব্যতিত সবাই নবীজির জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করে।
মুহাম্মাদ(সা:) এর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা’বা গৃহের পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরনো ইমারত ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়।
এভাবে পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি বাদে।কোন গোত্রের লোক এই মহৎ কাজটি করবে তা নিয়েই কোন্দল বেধে যায়। নির্মাণ কাজ সব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন ছিল একজনের কাজ। কে স্থাপন করবে এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় এবং চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে এটি এমনই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
এমতাবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন মুহাম্মাদ(সাঃ)সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। এতে সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়। আর তার প্রতি সবার সুগভীর আস্থাও ছিল। যা হোক এই দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ(সাঃ) অত্যন্ত সুচারুভাবে ফয়সালা করেন। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।

নবুওয়ত প্রাপ্তি :
এই সম্পর্কে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেল
‘আপনার নিকট আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা যেন আপনাকে সেগুলো থেকে বিমুখ না করে। আপনি প্রতিপালকের দিকে আহবান করুন এবং কিছুতেই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’।…সূরা ক্বাছাছ ২৮/৮৭
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নবুওয়াত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে আরো বলেন..
‘হে নবী! আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে’। ‘আল্লাহর অনুমতিতে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে’।…সূরা আহযাব ৩৩/৪৫-৪৬
চল্লিশ বছর বয়সে মুহাম্মাদ(সাঃ) নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই মহান আল্লাহ পাক তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুওয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন।
তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) তার কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিব্রাইল(আঃ) তাঁকে এই আয়াত ক’টি পড়তে বলেন:
“পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।”… সূরা আলাক
উত্তরে নবী জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিব্রাইল (আঃ) তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই আয়াত পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ(সাঃ) নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মুহাম্মাদ(সাঃ) আয়াতটি পড়তে সমর্থ হন। অবর্তীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন।
বারবার বলতে থাবেন, “আমাকে কম্বল দ্বারা আবৃত কর”। খাদিজা নবীর সকল কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন এবং তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেন। ভীতি দূর করার জন্য মুহাম্মাদ(সাঃ) কে নিয়ে খাদিজা নিজ চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফেলের কাছে যান। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে, ধীরে ধীরে আত্মস্থ হন নবী। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য।
একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্সির-এর কয়েকটি আয়াত। এরপর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ (সাঃ)।
এই ইসলাম ছিল জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়ার জন্য প্রেরিত একটি আদর্শ ব্যবস্থা। তাই এর প্রতিষ্ঠার পথ ছিল খুবই বন্ধুর আর কঠিন। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই নবীর মক্কার জীঁঁবন শুরু হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন..
’বলুন! ইহাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর পথে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ মহা পবিত্র আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।…সূরা ইউসুফ ১২/১০৮
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মক্কার জীবন :
‘আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে হেকমত ও উপদেশ দ্বারা আহবান করুন এবং তাদের সাথে উত্তম পন্থায় তর্ক করুন। তাঁর পথ থেকে কে পথভ্রষ্ট হয় সে ব্যাপারে আপনার প্রতিপালক অধিক জ্ঞাত এবং কে হেদায়াতপ্রাপ্ত তাও তিনি সবিশেষ অবহিত’।…সূরা নাহল ১৬/১২৫
এরপর নবী (সাঃ) বুঝতে পারেন যে, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে; কারণ তৎকালীন নেতৃত্বের ভীত ধ্বংস করা ব্যতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোন উপায় ছিলনা।
তাই প্রথমে তিনি নিজ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে গোপনে ইসলামের বাণী প্রচার শুরু করেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন খাদিজা। এরপর মুসলিম হন মুহাম্মাদ(সাঃ) এর চাচাতো ভাই এবং তার ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলী, ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর।
ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য নবী নিজ বংশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন; এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শ মেনে নেয়নি। ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিল নবীর অন্তরঙ্গ বন্ধু আবু বকর। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। এবং এই প্রচার কাজ চলতে থাকে সম্পূর্ণ গোপনে।
পবিত্র কোরআনে এই সত্যের দাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন…
‘আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে হেকমত ও উপদেশ দ্বারা আহবান করুন এবং তাদের সাথে উত্তম পন্থায় তর্ক করুন। তাঁর পথ থেকে কে পথভ্রষ্ট হয় সে ব্যাপারে আপনার প্রতিপালক অধিক জ্ঞাত এবং কে হেদায়াতপ্রাপ্ত তাও তিনি সবিশেষ অবহিত’।… সূরা নাহল ১৬/১২৫
প্রকাশ্য দাওয়াত :
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষনা করেন..
‘আপনার নিকট আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা যেন আপনাকে সেগুলো থেকে বিমুখ না করে। আপনি প্রতিপালকের দিকে আহবান করুন এবং কিছুতেই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’।…সূরা ক্বাছাছ ২৮/৮৭
তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেয়ার পর মুহাম্মাদ(সাঃ) প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। এ ধরণের প্রচারের সূচনাটা বেশ নাটকীয় ছিল। নবী সাফা পর্বতের ওপর দাড়িয়ে চিৎকার করে সকলকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসূল। কিন্তু এতে সকলে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড খেপে যায় এবং এই সময় থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার শুরু হয়।
মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন :
পৌত্তলিক আর বিরুদ্ধবাদীরা কয়েকটি স্তরে নির্যাতন শুরু করে ইসলাম ও মুহাম্মাদ(সাঃ) এর বিরুদ্ধে
- প্রথমে তারা উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি করত,
*এরপর অপপ্রচার, কূটতর্ক এবং নীতিহীন যুক্তি।
এক সময় ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় যাকে সফল করার জন্য একটি নেতিবাচক দল গড়ে উঠে। একই সাথে গড়ে তোলা হয় সাহিত্য ও অশ্লীল গান-বাজনার দল।সর্বশেষ যখন তারা দেখে যে কোন ভাবেই মুহাম্মাদ(সাঃ) কে থামানো যাচ্ছে না এই কাজ থেকে তখন তার সাথে আপোষেরও প্রচেষ্টা চালায় কুরাইশরা। কিন্তু মুহাম্মাদ(সাঃ) তা মেনে নেননি; কারণ আপোষের শর্ত ছিল নিজের মত ইসলাম পালন করা, সেক্ষেত্র তার ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ভেস্তে যেতো।
এই সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন…
‘অতএব আপনি তার দিকে আহবান করুন ও তাতেই দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকুন যেভাবে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন এবং তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবেন না। বল, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস করি এবং আমি আদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে। আল্লাহই আমাদের প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের ও তোমাদের কর্ম তোমাদের। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ নেই। আল্লাহই আমাদেরকে একত্রিত করবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁরই দিকে’।… সূরা শূরা ৪২/১৫
মুসলমানদের প্রথম ইথিওপিয়ায় হিজরত :
ইসলাম গ্রহনকারী মুসলিমানদের বিরুদ্ধে মক্কায় সহিংসতা চরম রূপ ধারণ করে, তখন নবী (সাঃ) কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে পাঠান। সেখান থেকেও কুরাইশরা মুসলিমদের ফেরত আনার জন্য চেষ্টা করে, যদিও তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর কারণে তা সফল হয়নি।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ :
ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হল উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। নবী সবসময় চাইতেন যেন আবু জেহেল ও উমরের মধ্যে যেকোন একজন অন্তত ইসলাম গ্রহণ করে। তার এই ইচ্ছা এতে পূর্ণতা লাভ করে।
আরব সমাজে উমরের বিশেষ প্রভাব থাকায় তার ইসলাম গ্রহণ ইসলাম প্রচারকে খানিকটা সহজ করে, যদিও কঠিন অংশটিই তখনও মুখ্য বলে বিবিচেত হচ্ছিল। এরপর নবীর চাচা হামযা ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণে আরবে মুসলিমদের আধিপত্য কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়।
মক্কায় মুসলমানদের এক ঘরে অবস্থা :
এভাবে ইসলাম যখন শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে তখন মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার অনুসারী সহ বনু হাশেম গোত্রকে একঘরে করে রাখে। তিন বছর নির্মম মানবেত ভাবে আটক থাকার পর তারা মুক্তি পায়।
দুঃখের বছর ও তায়েফ গমন :
মুক্তির পরের বছরটি ছিল মুহাম্মাদ(সাঃ) এর জন্য আরো দুঃখের ওষ্টের বছর। কারণ এই বছরে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তার স্ত্রী বিবি খাদিজা (রাঃ) ও চাচা আবু তালিব মারা যায়। দুঃখের সময়ে নবী মক্কায় ইসলামের প্রসারের ব্যাপরে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন। এবার ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান (অবশ্য তায়েফ গমনের তারিখ নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে)।
কিন্তু সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত অপমান, ক্রোধ ও উপহাসের শিকার হন। এমনকি তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদেরকে মুহাম্মাদ(সাঃ) পিছনে লেলিয়ে দেয়; তারা ইট-প্রস্তরের আঘাতে নবীকে রক্তাক্ত করে দেয়। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি; নতুন সম্ভবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন যে..
‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম কথা কার, যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত’।…সূরা ফুছছিলাত ৪১/৩৩
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মি’রাজ তথা উর্দ্ধারোহন :
এমন কষ্টের সময়েই শুভ এক ঘটনা ঘটে। সহিহ ভাষ্যমতে এ সময় মুহাম্মাদ(সাঃ) এক রাতে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যান; এই ভ্রমণ ইতিহাসে ইসরা নামে পরিচিত। কথিত আছে, মসজিদুল আকসা থেকে তিনি উর্দ্ধারোহণ করেন এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন, এছাড়া তিনি বেহেশ্ত ও দোযখ সহ মহাবিশ্বের সকল স্থান অবলোকন করেন। এই যাত্রাকে ইতিহাসে মি’রাজ নামে পরিচিত।
মদীনায় হিজরত :
‘হে ঈমানদারগণ! রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহবান করে যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে, তখন আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দিবে। জেনে রাখ যে, আল্লাহ সম্মুখ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী হয়ে থাকেন এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে’।
…সূরা আনফাল ৮/২৪
এরপর সূচিত হয় নতুন এক ঘটনা। মদীনার থেকে বেশ কিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মূলত হজ্জ্ব করতে এসে ইসলামে দাওয়াত পেয়েছিল।
এরা আকাব নামক স্থানে মুহাম্মাদ(সাঃ) এর কাছে শপথ করে যে তারা যে কোন অবস্থায় নবীকে রক্ষা করবে এবং ইসলামে প্রসারে কাজ করবে। এই শপথগুলো আকাবার শপথ নামে সুপরিচিত।
এই শপথগুলোর মাধ্যমেই মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একসময় মদীনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাঃ) কে মদীনায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। মদীনা তথা ইয়াসরিবে অনেক আগে থেকে প্রায় ৬২০ সাল পর্যন্ত গোত্র গোত্র এবং ইহুদীদের সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকে। বিশেষত বুয়াছের যুদ্ধে সবগুলো গোত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ায় প্রচুর রক্তপাত ঘটে।
এ থেকে মদীনার লোকেরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, রক্তের বিনিময়ে রক্ত নেয়ার নীতিটি এখন আর প্রযোজ্য হতে পারেনা। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার যে সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবে। এ চিন্তা থেকেই তারা মুহাম্মাদ(সাঃ) কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যদিও আমন্ত্রণকারী অনেকেই তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। এই আমন্ত্রণে মক্কার মুসলিমরা মক্কা থেকে সবাই গোপনে হিজরত করে মদীনায় চলে যায়। সবশেষে মুহাম্মাদ(সাঃ) ও আবু বকর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন। এদিকে তাদের হিজরতের দিনেই কুরাইশরা মুহাম্মাদ(সাঃ) কে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তাতে সফল হয়নি আর এভাবেই মক্কী যুগের সমাপ্তি ঘটে।

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মদিনার জীবন :
তখনকার দিনে নিজ গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে যোগদান করে বাস করাটা আরবে অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হত। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সেরকম নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইসলামের বন্ধনই শ্রেষ্ঠ বন্ধন হিসেবে মুসলিমদের কাছে পরিগণিত হত। এটি তখনকার যুগে একটি নতুন বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। ইসলামী পঞ্জিকায় হিজরতের বর্ষ থেকে আরবি দিন গণনা শুরু হয়। এজন্য ইসলামী পঞ্জিকার বর্ষকে হিজরি বলে উল্লেখিত থাকে যার অর্থ After Hijra।
স্বাধীন রাষ্ট্র ও সংবিধান প্রণয়ন :
মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। তখন বিবাদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল আওস ও খাযরাজ। তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করেছিলেন।
মদীনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন ঐতিহাসিকগন। এই সনদের মাধ্যমে মদিনায় বসবাসরত সকল গোত্রের রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। আওস ও খাযরাজ উভয় গোত্রই তখন ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদী গোত্র বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদির। সবসহ মদিনায় বসবাসরত মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এই সনদের মাধ্যমে মদীনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ(সাঃ) হলেন তার প্রধান ও নেতা।
মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ :
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে মক্কার সাথে সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মুহাম্মাদ(সঃ) মদীনায় এসে আশেপাশের সকল গোত্রের সাথে সন্ধি চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ছিলেন।
মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলমাদের সম্পত্তি ক্রোক করে। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ (সাঃ) ৩০০জন সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁধা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাঠায়। কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়।
কিন্তু তারা এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়। আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়। যাহোক, এই সময় থেকেই ইসলামের ইতিহাসের নতুন দিনের সূচনা ঘটে।
এরপর ৬২৫ সালে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিতে হয়। এতে প্রথম দিকে মুসলিমরা পরাজিত হলেও শেষে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। কুরাইশরা প্রথমে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত মুহূর্তের নীতিগত দূর্বলতার কারণে পরাজিতের হয়।
এরপর ৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদীনা আক্রমণ করে। কিন্তু এবারও খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধ বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে মুসলিমরা আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে আশেপাশের অনেক গোত্রের উপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয় এবং তার পরবর্তিতে ইসলাম বিস্তারে সফল ভূমিকা রাখে।

মদীনার ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক :
একটা সময় মদীনার বসবাসকারী ইহুদীরা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে দেখা দেয়। মূলত ইহুদীরা বিশ্বাস করত না যে, একজন অ-ইহুদী মানুষ নবী হতে পারে। এজন্য তারা কখনই ইসলামের আদর্শকে মেনে নেয়নি এবং যখন ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি বুঝতে পারে তখন তারা এর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। আর ধর্মীয় দিক দিয়ে চিন্তা করলে আহলে কিতাব হয়েও শেষ নবীকে মেনে নেয়া তাদের উচিত ছিল কিন্ত তারা তা না করে গোপনে ইসলামের বিরুধীতা করতে থাকে আর সেই কারনে তাদের সাথে করা সন্ধি ভঙ্গ হয়ে যায়।
হুদাইবিয়ার সন্ধি :
মুহাম্মাদ (সাঃ) হলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রধান। তিনি যে একজন দূরদর্শী ও সফল রাজনীতিবিদ এখানেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মদিনার সনদ নাগরিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থাপিত হয় ঐক্য।
বিশ্বনবী (সাঃ) তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেননি বরং উদারতার মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর ও নবদীক্ষিত মুসলমানগণের (সাহাবায়ে কেরাম) চালচলন, কথাবার্তা, সততা ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে যখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল তখন কুরাইশ নেতাদের মনে হিংসা ও শত্রুতার উদ্রেক হয়। অপরদিকে মদিনার কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রাধান্য সহ্য করতে না পেরে গোপনভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কাফিরদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্যই মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন বাধ্য হয়ে তলোয়ার ব্যবহার করছিলেন। যার ফলে বদর, উহুদ ও খন্দকসহ অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এসব যুদ্ধের প্রায় সবগুলোতেই মুসলমানগণ জয়লাভ করেন। বিশ্বনবী (সাঃ) মোট ২৭টি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ষষ্ঠ হিজরিতে ১৪০০ নিরস্ত্র সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ) মাতৃভূমি দর্শন ও পবিত্র হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত।
সন্ধির শর্তাবলির মধ্যে এ কথাগুলোও উল্লেখ ছিল যে-
(১) মুসলমানগণ এ বছর ওমরা আদায় না করে ফিরে যাবে।
(২) আগামী বছর হজ্বে আগমন করবে, তবে ৩ দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না।
(৩) যদি কোনো কাফির স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলমান হয়ে মদিনায় গমন করে তাহলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে। পক্ষান্তরে মদিনা হতে যদি কোনো ব্যক্তি পলায়নপূর্বক মক্কায় চলে আসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না।
(৪) প্রথম থেকে যে সকল মুসলমান মক্কায় বসবাস করছে তাদের কাউকে সাথে করে মদিনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না।
(৫) আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলোর এ স্বাধীনতা থাকবে যে, তারা উভয় পক্ষের (মুসলমান ও কাফির) মাঝে যাদের সঙ্গে ইচ্ছা সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।
(৬) সন্ধিচুক্তির মেয়াদের মধ্যে উভয় পক্ষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যাতায়াতের সম্পর্ক চালু রাখতে পারবে। কুরাইশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন আমর সন্ধিপত্র থেকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্য দুটি কেটে দেয়ার জন্য দাবি করেছিল।
কিন্তু সন্ধিপত্রের লেখক হযরত আলী (রা.) তা মেনে নিতে রাজি হলেন না। অবশেষে বিশ্বনবী (সাঃ) সুহায়েল বিন আমরের আপত্তির প্রেক্ষিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্য দুটি নিজ হাতে কেটে দেন এবং এর পরিবর্তে সুহায়েল বিন আমরের দাবি অনুযায়ী ‘বিছমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখতে নির্দেশ দেন।
সুতরাং বাহ্যিক দৃষ্টিতে এ সন্ধি মুসলমানদের জন্য অপমানজনক হলেও তা মুহাম্মাদ (সাঃ) কে অনেক সুযোগ ও সুবিধা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল। এ সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রাজনৈতিক সত্তাকে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
সন্ধির শর্তানুযায়ী অমুসলিমগণ মুসলমানদের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায়। ফলে অমুসলিমগণ ইসলামের মহৎ বাণী উপলব্ধি করতে থাকে এবং পরবর্তিতে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এ সন্ধির পরই মুহাম্মাদ (সাঃ) বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন।
বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র প্রেরণ
রাসূল (সাঃ)সারা বিশ্বের রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। সুতরাং পৃথিবীর সব জায়গায় ইসলামের আহ্বান পৌঁছে দেয়া তাঁর দায়িত্ব ছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলো থেকে আশ্বস্ত হয়ে এ কাজে মননিবেশ করেন।
সেসময়ে পৃথিবীর প্রধান রাজশক্তিগুলো ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য (the holy roman empire),এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য এবং আফ্রিকার হাবশা সাম্রাজ্য। এছাড়াও মিশরের ‘আযীয মুকাউকিস, ইয়ামামার সর্দার এবং সিরিয়ার গাসসানী শাসনকর্তাও বেশ প্রতাপশালী ছিল। তাই ষষ্ঠ হিজরীতে একইদিনে এদের কাছে ইসলামের আহ্বান পত্রসহ ছয়জন দূত প্রেরণ করেন।
প্রেরিত দূতগণের তালিকা :
- দাহিয়া ক্বালবী (রাঃ) কে রোমসম্রাট কায়সারের কাছে।
- আবদুল্লাহ বিন হুযাফা (রাঃ)কে পারস্যসম্রাট পারভেজের কাছে।
- হাতিব বিন আবূ বুলতা’আ (রাঃ) কে মিশরের শাসনকর্তার কাছে।
- আমর বিন উমাইয়া (রাঃ) কে হাবশার রাজা নাজ্জাশীর কাছে।
- সলীত বিন উমর বিন আবদে শামস (রাঃ) কে ইয়ামামার সর্দারের কাছে।
- শুজাইবনে ওয়াহাব আসাদী (রাঃ) কে গাসসানী শাসক হারিসের কাছে।
শাসকদের মধ্য হতে শুধুমাত্র বাদশাহ নাজ্জাসী ছাড়া কেউ ইসলাম গ্রহণ করেননি।
মুসরমনাদের মক্কা বিজয় :
দশ বছর মেয়াদি করা হুদাইবিয়ার সন্ধি মাত্র দু’বছর পরেই ভঙ্গ করে মক্কাবাসি। খুযাআহ গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র, অপরদিকে তাদের শত্রু বকর গোত্র ছিল কুরাইশদের মিত্র। এক রাতে বকর গোত্র খুযাআদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়।
কুরাইশরা এই আক্রমণে অন্যায় ভাবে বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সহয়োগিতা করে।বর্ণনামতে কুরাইশদের কিছু যুবকও এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনার পর মুহাম্মাদ (সাঃ) কুরাইশদের কাছে তিনটি শর্তসহ পত্র প্রেরণ করেন এবং কুরাইশদেরকে এই তিনটি শর্তের যে কোন একটি মেনে নিতে বলেন।
শর্ত তিনটি হলো :
- কুরাইশ খুযাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করবে।
- অথবা তারা বকর গোত্রের সাথে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে।
- অথবা ঘোষণা দিবে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে এবং কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
কুরাইশরা জানালো যে, তারা শুধু তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করবে। কিন্তু খুব দ্রুত কুরাইশ তাদের ভুল বুঝতে পারলো এবং আবু সুফয়ানকে সন্ধি নবায়নের জন্য দূত হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করলো। কিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ) কুরাইশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করলেন।
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ (সাঃ) দশ হাজার সাহাবীর বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন।
সেদিন ছিল অষ্টম হিজরীর রমজান মাসের দশ তারিখ। বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ছাড়া মোটামুটি বিনাপ্রতিরোধে মক্কা বিজয় হলো এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) বিজয়ীবেশে সেখানে প্রবেশ করলেন। তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন। তবে দশজন নর এবং নারী এই ক্ষমার বাইরে ছিল। তারা বিভিন্নভাবে ইসলাম ও মুহাম্মাদ (সাঃ)এর কুৎসা রটাত। তবে এদের মধ্য হতেও পরবর্তিতে কয়েকজনকে ক্ষমা করা হয়। মক্কায় প্রবেশ করেই মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বপ্রথম কাবাঘরে আগমন করেন এবং সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস করেন।
মুসলমানদের শান-শওকত দেখে এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)এর ক্ষমাগুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসীই ইসলাম গ্রহণ করে। এই বিষয় পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন
“ ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করো,সত্য-সঠিক কাজের আদেশ দাওআর অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলো।… আল কুরআন
পবিত্র কোরআনে এই বিজয়ের ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।

মক্কা বিজয়ের পর :
যে মক্কা থেকে বিশ্বনবী (সাঃ) নির্যাতিত অবস্থায় বিতাড়িত হয়েছিলেন, সেখানে আজ তিনি বিজয়ের বেশে উপস্থিত হলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত ওরম ফারুক (রা.) কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে গ্রেফতার করে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সম্মুখে উপস্থিত করেন। কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হাতে পেয়েও ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার এ মহান আদর্শ পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল। মক্কায় আজ ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীয়মান। সকল অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়।
বিদায় হজ্ব :
৬৩১ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক দশ হিজরিতে মুহাম্মাদ (সাঃ) লক্ষাধিক মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিদায় হজ্ব সম্পাদন করেন এবং হজ্ব শেষে আরাফাতের বিশাল ময়দানে প্রায় ১,১৪,০০০ সাহাবির সম্মুখে জীবনের অন্তিম ভাষণ প্রদান করেন,
যা ইসলামের ইতিহাসে ‘বিদায় হজ্বের ভাষণ’ নামে পরিচিত। বিদায় হজ্বের ভাষণে বিশ্বনবী (সাঃ) মানবাধিকার সম্পর্কিত যে সনদপত্র ঘোষণা করেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা আজও অতুলনীয়।
তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন
(১) হে বন্ধুগণ, স্মরণ রেখ, আজিকার এ দিন, এ মাস এবং এ পবিত্র নগরী তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র, তেমনি পবিত্র তোমাদের সকলের জীবন, তোমাদের ধন-সম্পদ, রক্ত এবং তোমাদের মান-মর্যাদা তোমাদের পরস্পরের নিকট। কখনো অন্যের ওপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না।
(২) মনে রেখ, স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে ।
(৩) সাবধান, শ্রমিকের মাথার ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দেবে ।
(৪) মনে রেখে যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না ।
(৫) চাকর-চাকরানিদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ো না। তোমরা যা খাবে, তাদের তাই খেতে দেবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদের তাই (সমমূল্যের) পরিধান করতে দেবে।
(৬) কোনো অবস্থাতেই ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না।
এমনিভাবে মানবাধিকার সম্পর্কিত বহু বাণী তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে পেশ করে যান। তিনি হলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, মানবজাতির একমাত্র আদর্শ এবং বিশ্ব জাহানের রহমত হিসেবে প্রেরিত।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর নবুয়্যতের ২৩ বছরের আন্দোলনে আরবের একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিলেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করেন।
★ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দিয়ে, তিনি ঘোষণা করেন, ‘অনারবের ওপর আরবের এবং আরবের ওপর অনারবদের; কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো পার্থক্য নেই। বরং তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে অধিক মুত্তাকিন।
★ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সূদকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জাকাতভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে এমন একটি অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তাদের আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করেছিল।
★ সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর কোনো মর্যাদা ও অধিকার ছিল না। বিশ্বনবী (সাঃ) নারী জাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং ঘোষণা করলেন ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ নারী জাতিকে শুধুমাত্র মাতৃত্বের মর্যাদাই দেননি, উত্তরাধিকার ক্ষেত্রেও তাদের অধিকারকে করেছেন সমুন্নত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
★ক্রীতদাস আযাদ করাকে তিনি উত্তম ইবাদত বলে ঘোষণা করেন।
★ ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেখানে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা এবং বিভিন্ন বস্তুর পূজা আরববাসীদের জীবনকে কলুষিত করেছিল সেখানে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেন।
মোদ্দা কথা তিনি এমন একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে কোনো হানাহানি, রাহাজানি, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যভিচার, সূদ, ঘুষ ইত্যাদি ছিল না।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ইন্তকাল :
বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মাদ (সাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বরের তাপমাত্রা প্রচন্ড হওয়ার কারণে পাগড়ির ওপর থেকেও উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছিল। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন।
অসুস্থতা তীব্র হওয়ার পর তিনি সকল স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আয়েশা (রাঃ)এর কামরায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর কাছে সাত কিংবা আট দিনার ছিল, মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি এগুলোও দান করে দেন।
বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে।
এ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ১২ রবিউল আউয়াল ১১ হিজরি মোতাবেক ৭ জুন ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি হলেন ইসলাম ধর্মের আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। পৃথিবীর বুকে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। হযরত আলী (রাঃ) তাকে গোসল দেন এবং কাফন পরান। আয়েশ (রাঃ)এর কামরার যে স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, জানাযার পর সেখানেই তাকেঁ দাফন করা হয়।
ইন্তেকালের পূর্বে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) গোটা মুসলিম জাতির উদ্দেশ করে বলে গিয়েছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যত দিন তোমরা এ দুটি জিনিসকে আঁকড়ে রাখবে তত দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন আর অপরটি হলো আমার সুন্নাহ অর্থাৎ হাদিস।’
বিশ্বনবী (সা.) এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন, ‘He was the mater mind not only of his own age but of all ages’ অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সা:) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।
শুধুমাত্র ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুরই নন, পৃথিবীর বুকে যত মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান বাণী পৃথিবীর বুকে রেখে গেছেন।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’.. সূরা-আহযাব-২১
বর্তমানে অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও দ্বন্দ্বমুখর আধুনিক বিশ্বে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আদর্শকে অনুসরণ করা হলে বিশ্বে শান্তি ও একটি অপরাধমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে সম্ভব।

ইসলামী বর্ণনামতে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অলৌকিকত্ব :
ব্যতিক্রম কাজের প্রতি আকর্ষন মানুষের স্বভাবজাত, অন্যদিকে অলৌকিকত্বের প্রভাব আমাদের লৌকিক জীবনে সুদূর প্রসারী। আরবী মু’জেযা শব্দের অর্থ আসাধারন বিষয়, অলৌকিকত্ব। মুহাম্মাদ (সঃ) এর অসংখ্য মু’জেযার মধ্যে প্রকাশ্য মু’জেযার সংখ্যা দশ হাজারেরও অধিক।
ব্যাখ্যাকারীগণ মুহাম্মাদ (সঃ) মু’জেযাগুলোকে তিনভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেনঃ
প্রথমত যা তাঁর দেহ হতে বহির্ভূত যথা- চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া, বৃক্ষ নিকটে আসা ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত যা তাঁর দেহসম্পৃক্ত যথা- ‘মোহরে নবুওয়াত’ যা হলো দুই কাঁধের মাঝখানে আল্লাহর রাসূল মোহাম্মাদ (সঃ) বাক্যটি লেখা ছিল।
তৃতীয়ত তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী যথা- নির্ভিক, অকুতোভয়, দানশীল, সত্য ভাষণকারী, দুনিয়াবিমুখ ইত্যাদি।
আল কোরানের সুরা ক্বামারে মুহাম্মাদ (সাঃ)আংগুল দ্বারা চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার কথা বলা আছে।
বদর যুদ্ধের আগের দিন বদর নামক স্থানে পৌঁছে মুহাম্মাদ (সাঃ)বললেন ‘এটা আমুকের শাহাদাতের স্থান, এটা অমুকের (কাফেরের) হত্যার স্থান… সাহাবীরা (রা.) বলেন ‘রাসুলুল্লাহ! সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার জন্য যে স্থান দেখিয়েছেন, তার সামান্য এদিক সেদিক হয়নি।’ ( সহিহ মুসলিম) বিভিন্ন যুদ্ধে আকাশের ফেরেশতাগন অংশগ্রহন করতো। যা আল্লাহর সাহায্য ও রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মু’জেযার প্রমান।
হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন- ‘ ওহুদের যুদ্ধের দিন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ডানে বামে সাদা পোষাকের দু’জন লোক (জিব্রাইল, মিকাইল) দেখলাম যাদের কে আর কোন দিন দেখেনি। (বুখারী, মুসলিম)
সাহাবীর ভাংগা পা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্পর্শে ভালো হওয়া আরো একটি মু’জেযা।
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক (রাঃ) এর পা ভেংগে গেলে তিনি তা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জানালে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পায়ের উপর হাত বুলালেন। সাহাবী বলেন- ‘এতে আমার পা এমনভাবে সুস্থ হয়ে গেলো যেন তাতে আমি কখনো আঘাতই পাইনি। (বুখারী) স্বল্প খাদ্যে হাজার মানুষের পরিতৃপ্ত ভোজন হওয়া প্রিয়নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উল্লেখযোগ্য মু’জেযা।
এরুপ বহু ঘটনা বহু সাহাবী বর্ণনা করেছেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল সাহাবীগন ক্ষুধায় অস্থির ও দুর্বল হয়ে পরেছিলেন তখন জাবের (রাঃ) একটি বকরীর বাচ্চা জবাই করলেন আর এক সের পরিমান জবের রুটি তৈরি করলেন আর তা দিয়েই সবাই তৃপ্তিতে খেলেন। সাহাবী জাবের (রাঃ) আল্লাহর শপথ করে বলেন- ‘সকলে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলে যাওয়ার পরও চুলায় গোশত ভর্তি ডেকচি ফুটছিল এবং রুটি হচ্ছিল।’ (বুখারী, মুসলিম)
সুপ্রিয় সুহৃদয়, আপনাদের খেদমতে আমার মত নগন্য মানুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মহামূল্য জীবনী বিভিন্ন বই ও মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সম্পাদনার দুঃসাহস দেখিয়েছি, আমার কোন তথ্য উপাত্ত যদি কারো কাছে ভুল হিসাবে চোখে পড়ে দয়া করে কমেন্সের মাধ্যমে জানালে উপকৃত হব।
এবং পরবর্তিতে আরো সতর্কতার সহিত কাজ করতে সচেষ্ট থাকব।
মহান আল্লাহ সবাই কে নেক হায়াত দান করুন এবং পবিত্র কোরআন ও সহিহ সুন্নাহের মতে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।
সম্পাদনায় : আজম পাটোয়ারী।
লেখক সাহিত্যিক।