স্নিগ্ধা ঘোষ
জানালার দু’টো রড় দু’হাতে ধরে, বাইরের দিকে উদাসীন চোখে তাকিয়ে কিছু দেখছে লীলা। বাইরের দিকে তাকিয়েই দীর্ঘ বাহান্ন বছরের স্মৃতি উকি মারে তার মনে। আজ বাড়িতে কত লোকজন, কিন্তু তাও সে একাকিনী।
সেই পনেরো বছর বয়সে এই বাড়ীর বৌ হয়ে আসে সে। তার শ্বশুরবাড়ী কোনো জমিদার বাড়ীর তুলনায় কম নয়।স্বামীরা ছয় ভাই হওয়ায় বাড়ীটা বড়ো করেই তৈরী করেন তারা। স্বামী চাষবাস করতেন, আর তার বাকি ভাইয়েরা চাকরি করায় একে একে সকলেই গ্রামের বাড়ী ছেড়ে শহরে চলে যায়। বাড়ী থেকে চলে যাওয়ার পর একবারের জন্যও এই বাড়ীতে উঁকি মারেনি তারা।
শাশুড়িকে সবসময় ভয় করে চলতো, কখনোই তাঁর মুখের উপর কথা বলতে পারেনি লীলা। পনেরো বছর বয়সী রিনির যখন বিয়ে দেয়, তখনও স্বামী আর শাশুড়ির বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার। বলতে পারেনি, মেয়ে পড়াশোনা করতে চায় এখন। সেই অভিমানে রিনিও আর বাড়ি আসেনি।
শাশুড়ির পছন্দ ছিল না, লীলা বাইরের কারোর সঙ্গে বেশি কথা বলুক। তাই উৎসব ছাড়া কারোর সঙ্গে তেমন মেলামেশাও হয়ে ওঠেনি ইচ্ছা থাকলেও।
ছেলের যখন চোদ্দ বছর বয়স, তখন লীলার স্বামী মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পরেও কেউ খোঁজ নেয়নি। তারপর থেকে তার উপর শাশুড়ির সন্দেহ যুক্ত হয়। তাই যেটুকু বাতাস সে পেতো, সেইটুকুতে নিঃশ্বাস নেওয়াও বন্ধ হয়ে গেল।
এখন লীলার কাজ পাড়ার কিছু ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে, নিজের ছেলের ভবিষ্যত গড়া। ছেলে ডাক্তার হতে চায়, তাই মাধ্যমিকের পর সায়েন্সে ছেলেকে ভর্তি করে।
ছেলে ইলেভেনে পড়ার সময়, লীলার শাশুড়ি মারা যান। এখন তার সমস্ত ধ্যান শুধু ছেলেকে মানুষ করার পিছনে। তাই দিন-রাত টিউশনি পড়ায় লীলা। বাইরের কারোর সঙ্গে কথা বলার অভ্যাসটাও চলে গেছে, বহু দিনের অভ্যাসে।
ছেলে দশ বছর পর প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। লীলা ছেলেকে বলতে থাকে, “কবে আমাকে নিয়ে যাবি এখান থেকে? এই মৃত্যুপুরীতে থাকতে আমার ভালো লাগে না।”
ছেলে বলে, “নিয়ে আসবো মা।”
কিন্তু ওই পর্যন্তই। মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে তার দায়িত্ব শেষ। দু’বছর পর ছেলে বিয়ে করে বাইরেই নিজের চেম্বার খোলে।
লীলা অপেক্ষা করে থাকে, বাড়ীতে কোনো মানুষের আসার জন্য। ওই জানালাটিই লীলার একমাত্র সঙ্গী। কাজের শেষে জানালাটাকেই লীলা নিজের মনের কথা বলে, আর ওখানে বসেই অপেক্ষা করে।
কুড়ি বছর পরে আজ লীলার অপেক্ষার অবসান হয়েছে। আজ বাড়ী ভর্তি লোকজন। জানালার বাইরে লীলা দেখতে থাকে, খাটিয়ায় শুয়ে থাকা দেহটা, তার ছেলের কাঁধে।
কিন্তু, তার দেহের মুক্তি হলেও, আত্মা যে আজও এই ঘরেই বন্দিনী!
Akakirto dhire dhire ovyas a porinoto hy.😔😔