মাওলানা ইব্রাহিম খলিল মাহমুদী
আল্লাহ তাআলা সুন্দর এই পৃথিবী নানা রকম মাখলুকাত দিয়ে সাজিয়েছেন, অপূর্ব এ পৃথিবীর সৌন্দর্য্যের লীলাভূমিতে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতি কে সৃষ্টি করেছেন।
মানবজাতির বংশ পরম্পরা বৃদ্ধির একমাত্র মাধ্যম বা ওসীলা হলেন মা-বাবা। একজন সন্তানের পৃথিবীতে শুভাগমন, তার পরিচর্যা, শারীরিক মানসিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে মা-বাবা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন যার কোন তুলনা হয় না যে ঋণ অপূরণীয়।
এজন্যই ইসলাম ধর্মে মহান আল্লাহ তাআলার ইবাদত তথা উপাসনার পরপরই যাদের খেদমত বা সেবা করার কথা বলা হয়েছে তারা হলেন মা-বাবা এ মর্মে আল্লাহ তা’আলা বলেন
“এবং তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে তোমরা তাকে ছাড়া আর কারও এবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। পিতা-মাতা উভয়ে বা তাদের একজন যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে তাদেরকে উফ বলবে না তাদের প্রতি সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ করবে না তাদেরকে ধমক দেবে না এবং তাদের সাথে সম্মানজনক বিনম্র কথা বলবে।
মমতা বসে তাদের জন্য নম্রতার পক্ষপুটে অবনমিত করে রাখবে এবং বলবে হে আমার প্রভু আপনি তাদেরকে দয়া করুন যেমনভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন তোমাদের অন্তরে কি আছে তা তোমাদের রব ভালো জানে তোমরা যদি সৎকর্মশীল হয় তবে তিনি আল্লাহ ক্ষমাকারী।… সূরা বনী ইসরাঈল ২৩/২৪
এ পৃথিবীতে যুগে যুগে পথ হারা মানব জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা নবী রাসূলদের কে প্রেরণ করেছেন যারা ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ,যারা সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসরণীয় ,অনুকরণীয় ,তারাও তাদের মাতা পিতার খেদমতে নিজেদের ব্রত রেখেছেন, তারা ছিলেন মাতা-পিতার অনুগত ,তাদের সেবা করতেন, তাদের জন্য দোয়া করতেন। পিতার আনুগত্যের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সাল্লাম। যখন তার পিতা তাকে জানালেন যে তিনি স্বপ্নে তাকে কুরবানী করার নির্দেশ পেয়েছেন তখন তিনি অবিচল চিত্তে পিতার সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
আল্লাহ তায়ালা পিতা-পুত্রের আদর্শের বিবরণ কুরআনুল কারীম বর্ণনা করেন যখন সেই ছেলে(ইসমাইল) তার পিতার (ইব্রাহিমের)সাথে কাজ করবার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহিম বললেন বৎস আমি স্বপ্নে দেখি যে আমি তোমাকে জবাই করছি এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলল:হে আমার পিতা আপনাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা আপনি করুন আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।.. সূরা আস-সাফফাত ১০২
পিতা-মাতার আনুগত্যে ও সেবার অর্থ:
পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবার অর্থ হলো আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী নয় এমন সকল নির্দেশ মান্য করা এবং সাধ্যমত তাদের সেবা যত্ন করা। বার্ধক্যজনিত কারণে, মানবীয় দুর্বলতায় বা কারো প্ররোচনায় পিতা-মাতা ও সন্তানের সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারেন।এক্ষেত্রে সন্তানের উপর ফরয হল ধৈর্য ধারণ করা এবং তাদের সাথে বিনয়ের সর্বোত্তম আচরণ করা।তাদের দুর্ব্যবহার বোকামি বা অন্যায়ের জন্য তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা তো দূরের কথা উফ বিরক্তি প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।বিনয় ও আদরের সাথে তাদের ভুল ধরে দেওয়া যেতে পারে তারা যদি দুর্ব্যবহার করুন না কেন তাদের সাথে সাধ্যমত বিনয় প্রকাশ করতে হবে ভালো ব্যবহার করতে হবে এবং সেবা করতে হবে।মুমিনের যথাসাধ্য আন্তরিক চেষ্টার পরেও কোনো কারণে পিতা-মাতা বিরক্ত থাকলে সেজন্য দুশ্চিন্তা নিষ্প্রয়োজন কারণ মুমিনের অন্তরে কি আছে তা আল্লাহ জানেন মুমিন যদি সাধ্যমত চেষ্টা করেন এবং ইচ্ছা করে ত্রুটি না করেন তবে অনিচ্ছাকৃত ভুল আল্লাহ ক্ষমা করবেন। নফল -মুস্তাহাব ইবাদতের চেয়ে
মাতা-পিতার খিদমাত বেশি পালনীয় :
পিতামাতার নির্দেশ বা প্রয়োজনে নফল মুস্তাহাব ইবাদত ছেড়ে দিয়ে তাদের খেদমত করতে হবে তবে তারা যদি ফরয-ওয়াজিব ইবাদত ত্যাগ করতে বলেন, বাহারাম বা মাকরূহ তাহরীমী পাপের নির্দেশ দেন তবে তা পালন করা যাবে না যেমন পিতা-মাতা প্রয়োজন হলে তাহাজ্জুদ চাশত, নফল নামাজ, নফল রোজা ও অন্যান্য নফল ইবাদত বাদ দিয়ে তাদের খেদমত করতে হবে ।আর যদি তারা নামায কাযা করতে ,যাকাত না দিতে,দাড়ি কাটতে বেপর্দা চলতে, সিনেমা দেখতে কারো ক্ষতি করতে, কারো হক নষ্ট করতে বা অনুরূপ কোন হারাম কাজের নির্দেশ দেন তবে মান্য করা যাবে না ।কিন্তু এ সকল নির্দেশের জন্য তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা যাবে না তাদের খেদমত করতে অবহেলা করা যাবেনা।
সূরা লোকমানের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন “এবং আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ এর নির্দেশ দিয়েছে জননী সন্তানকে কষ্টের উপর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করেন এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছর বৎসরে। অতএব আমার প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে যদি তোমার পিতা-মাতা তোমাকে পীড়াপীড়ি করে যে তুমি আমার সাথে শিরক করবে যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদাচরণের সাথে জীবন কাটাবে”।
পিতা মাতার খেদমতের একটি বিশেষ দিক কাজের জন্য অর্থ ব্যয় করা : সন্তান যেরূপ শারীরিকভাবে পিতা মাতার খেদমত করেন তদ্রুপ আর্থিকভাবে ও তাদের খেদমত করবে কেননা একজন মুমিনের ব্যয়ের খাত সমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম খাতই পিতা-মাতা।
আল্লাহ তা’আলা বলেন
“কি ব্যয় করবে সে বিষয়ে তারা আপনাকে প্রশ্ন করছে। আপনি বলুন তোমরা কল্যাণকর যা-কিছু ব্যয় করবে,তা পিতা-মাতা,আত্মীয়-স্বজন,
পিতৃহীন অনাথগন,দরিদ্রগন ও মুসাফিরের জন্য মুসাফিরের জন্য।…সূরা বাকারা ২১৫ আয়াত
জীবিত অবস্থায় সন্তানের জন্য মাতা পিতার হক সমূহ :
সন্তানের জন্য মাতা-পিতা অমূল্য সম্পদ যার কোন তুলনা হয় না । তাই প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য মাতা-পিতার যথাযথ খেদমত করা, সম্মান করা।
জীবিত থাকাকালীন তাদের হকগুলো নিম্নরূপ :
১.আজমত অর্থাৎ মাতা পিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া
২.মনেপ্রাণে তাদের ভালোবাসা
৩.সর্বদা তাদেরকে মেনে চলা
৪.তাদের খেদমত করা
৫.তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করা
৬.তাদেরকে সবসময় সুখে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করা
৭.নিয়মিত তাদের সাথে সাক্ষাত ও দেখাশোনা করা।
মৃত অবস্থায় সন্তানের জন্য মাতা-পিতার হকসমূহ :
মাতাপিতা এমনই আপনজন যা কিনা সন্তান কখনো ভুলতে পারে না একজন আদর্শবান সন্তান শুধু জীবিত অবস্থায়ই মাতা পিতার প্রার্থনা করে ক্ষান্ত হয় না মৃত্যুর পরেও সন্তান তার মাতা পিতার হক সময় আদায় করে।
মৃত মাতা-পিতার জন্য সন্তানের করণীয় নিম্নরূপ :
১.তাদের মাগফেরাত এর জন্য দোয়া করা
২.সওয়াব পৌঁছানো
৩.তাদের সাথী-সঙ্গী ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করা
৪.ঋণ পরিশোধ ও আমানত রক্ষা করা
৫.শরীয়ত সম্মত ওসিয়ত পূর্ণ করা
৬.সাথী-সঙ্গী ও আত্মীয়স্বজনদের সাহায্য করা
৭.সাধ্যমত তাদের কবর জিয়ারত করা।
পিতা-মাতার খেদমতের পুরস্কার : আল্লাহ তায়ালা তার ইবাদতের পরই পিতা মাতার খেদমতের আদেশ দিয়েছেন।
পিতা-মাতার আনুগত্য ইবাদত যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত এর পুরস্কার ও মহান পিতা মাতার খেদমত নামাজের পরেই সর্বোত্তম ইবাদত বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেনরাসূল বলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য হলোঃ সঠিক সময়ে সালাত আদায় করা এবং পিতা মাতার খেদমত করা ( বুখারী শরীফ)
অন্য হাদীসে রাসূল সাল্লাহু সালাম বলেন পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহর অসন্তুষ্টি (তিরমিজি শরীফ) ।
মহান আল্লাহ আমাদের কবূল করুন, বাবা মায়ের সেবা করার সুযোগ তৌফিক দান করুন। আমিন