জীবন চলার পথে চলতে গিয়ে এখনো নারীকে শুনতে হয় সে লক্ষী, পয়মন্ত না অপয়া।
এই শব্দগুলোর সাথে লড়াই করে যে নারীরা সমাজে টিকে আছে তারাই মানুষ হিসেবে সংগ্রাম করে। আর নারী মানে এক অভিশাপের নাম। যেখানে নারী হয়ে জন্মানো একটা পাপ।
নারী বিয়ের পর বাবার বাড়িতেই পর, শশুর বাড়িতে আপন নয় এবং কখনো বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের বোঝা হয়ে যান।
আজ নারীদের মুখেই শুনবো তাদের জীবনের সাথে লড়াই এর গল্প ।

১) আমি নিবেদিকা (ছদ্দনাম)
জয়ন্ত (ছদ্দনাম) সামাজিক ভাবে সুনাম এবং সম্মানে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ । উনার সাথে আছি বার বছর ধরে। আমার বয়স যখন ষোল বছর, তখন হতেই উনার সাথে পরিচয় । উনি আমার সাথে রাত না কাটালেও আমাদের দুজনের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক । আমার এবং আমার পরিবারের ভালো মন্দ সব তিনিই দেখা শোনা করেন । তার সহযোগিতায় আমার পড়াশোনা এবং নিজের চেষ্টায় ভালো চাকুরীর ব্যবস্থা ও হয়েছে। এভাবেই আমার অনার্স মাস্টার্সও শেষ হয়, তার পাশাপাশি আমি একজন নারী উদ্যোক্তা । নিজের ব্যবসা নিজে দেখাশোনা শুরু করলাম ।
যেহেতু আমি উনাকে ছাড়া আর কিছু কল্পনা করতে পারিনা এবং আমার আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে আমার চারপাশের সকলেই জানেন উনি আমার স্বামী। সেই কারণে তাকে জানালাম আমাদের বিয়ের কথা, যে আমাদের বিয়ে হবার পর আমাদের সন্তান তার পরিচয়ে বড় হয়ে মর্যাদা সম্পন্ন হবে ।
আমার কথা শুনে তিনি অস্বীকৃতি জানালেন, কেননা তিনি ছিলেন একজন বিবাহিত পুরুষ । তাছাড়া আমার বয়সী তার একটি পুত্র সন্তানও রয়েছে । আমি কয়েক বার কয়েক চাপ প্রয়োগ করাতে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন । শুধু তাই নয় তাকে দেখতে যাওয়ার কারণে ঐ মূহুর্তে পরিবারের কাছে তিনি বিতর্কিত হলেন এবং এক পর্যায়ে আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন ।
আমি মানি এবং জানি তিনি আমার পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছেন । তিনি যথেষ্ট ভালো মানুষ ও বটে শুধু তাই নয় বেশ সম্মানী মানুষও । আমার প্রশ্ন : আমি উচ্চপদস্থ নই বলে কী সামাজিক মর্যাদা পাবার অধিকারটুকুও আমার নেই ?
সম্পর্কটি বিতর্কিত, কিন্তু এখানে যদি আমরা কেবল নিবেদিকাকে দোষ দেই তবে ভুল হবে । কারণ জেনেশুনে ভুল যেমন নিবেদিকা করেছে তেমন জয়ন্তও করেছে । নিজের স্ত্রী পুত্র থাকতে সে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছে ।
২) আমি জান্নাতুল ফেরদৌস, খ্রিষ্টান ধর্ম হতে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্মীয় তৌহিদুল ইসলাম তুহিন কে বিবাহ করে মুসলমান ধর্ম লাভ করি । তাতে করে আমার পরিবার সামাজিক ভাবে বিপর্যস্ত হয় । আমার পরিবারকে সেই দ্বায়ে খ্রিষ্টান সমাজ একঘরে করে দেন ।
এদিকে তুহিন আমাকে বিয়ে করার কারণে তুহিনের বাবাও পুত্র হিসেবে তুহিনকে অস্বীকার করেন l তার অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ছয় মাস পর তুহিন এবং আমাকে স্বশুর বাড়ি থেকে মেনে নেয় । এইদিকে ততদিনে আমি দুইমাসের অন্তঃসত্ত্বা । কিন্তু স্বশুর বাড়ি থেকে এই সন্তান রাখতে অস্বীকৃতি জানালে, এক পর্যায়ে কোন উপায় না পেয়ে আমি বাধ্য হয়ে পেটের সন্তানকে নষ্ট করতে হয়। এদিকে আমার শাশুড়ি বাসায় কাজের বুয়া বন্ধ করলেন, বাড়িতে বৌ থাকতে বুয়াকে বাড়তি টাকা দিয়ে লাভ কি তাই ভেবে । আর আমি ভুলের প্রায়শ্চিত্তকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। আমি সংসার জীবন করতে এসে ধীরে ধীরে স্বামীর নির্যাতন, শাশুড়ির অত্যাচার মাথা পেতে নিতে লাগলাম ।

এভাবে মাস গড়িয়ে বছরে পা রাখলে আমি আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। তখন তুহিন জীবিকা নির্বাহের জন্য কেবল মাত্র একটি টিউশনি করে । একদিন আমি জানতে পারলাম তুহিন তার ছাত্রীকে বিয়ে করে ফেলেছে, তা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো । আমিতো তুহিনের দিকে তাকিয়েই ধর্ম, সমাজ, সংসার সব কিছু ত্যাগ করে এই সংসারে স্বামী ও শাশুড়ির সকল অত্যাচার মাথা পেতে নিচ্ছিলাম । আজ সেই স্বামীই কিনা আমার সাথে এতবড় বেইমানি করে বসলো ! আজ তো আমার কোথাও যাওয়ার জায়গাটিও রইলো না । এদিকে তুহিনের সন্তানও আমি আমার নিজের ভিতরে ধারণ করে চলেছি । একদিন তুহিন হঠাৎ করে বাসা হতে পালিয়ে গেলো, আর আমি এই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পড়ে রইলাম স্বশুর বাড়িতে, শাশুড়ির হাজারো নির্যাতনের মধ্যেই চলছে আমার প্রতিদিন। হঠাৎ তিনমাস পর খোঁজ পাওয়া গেলো যে তুহিন চট্টগ্রামে চাকুরী করছে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে । অনেক মিনতির পর তুহিন ছয় মাসে সাত মাসে একবার আসতো বাসায় l
এদিকে আমার কোল জুড়ে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। শুরু হলো নতুন করে লড়াই, আর এমনি ভাবেই অত্যাচার ও অনাচার এর মধ্যে সন্তানকে নিয়ে আমার জীবন থেকে দীর্ঘ বারটি বছর কেটে গেলো । এই বছরের মাঝামাঝি আমার সাথে তুহিন এর ডিভোর্স হয়ে গেছে ।এখন আমি লড়াই করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাঁচতে শিখেছি । নিজের কর্মদক্ষতা দিয়ে ব্যবসার মাধ্যমে আমিও এখন অনেক নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখাই ।
৩) আমি কানিজ ফাতেমা, ভুল করে বিয়ে করেছিলাম রেজাউলকে । রেজাউল এর মনের মধ্যে ছিল আমার বাবার অঢেল সম্পত্তির প্রতি লোভ, তার এই লোভ লালসার শিকার হলাম আমি । রেজাউলের সংসারে আমার আর রেজাউলের একমাত্র কন্যা সন্তান সুপ্তির জন্ম হয় । আমাকে তো দূরের কথা সুপ্তির জন্যও নূন্যতম ভালোবাসা ছিলোনা রেজাউল এর মনে কখনো। কিন্তু আমি সবটুকু উজাড় করে দিয়েই তাকে মনে প্রাণে ভালোবেসেছিলাম । তার বিনিময়ে সে আমাকে প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে জর্জরিত করে ফেলেছিল । এই দুঃসময়ে আমার পাশে দাঁড়ালো স্বয়ং আমার পরিবার এবং আমাকে বের করে আনলেন এই নরক যন্ত্রনা থেকে । এখন আমি আমার পরিবারের সাথে আমার একমাত্র কন্যা সুপ্তিকে নিয়ে অনেক ভালোই আছি । ঢাকাতে আছি একটি প্রাইভেট ব্যাংক এর ইনচার্জ হিসেবে ।
৪) আমি রুমা(ছদ্দনাম)
স্বামী জুনায়েদ আহমেদ(ছদ্দনাম) সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি । আমাদের সংসার জীবন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। আমি বাবা মায়ের চার নাম্বার সন্তান এবং সবার ছোট । এখানে বলে রাখা দরকার আমার বাবা গত হয়েছেন আমার বিবাহের একবছর আগে । পড়াশুনা পাসকোর্স শেষ করে মাস্টার্স এবং ল’তে এডমিশন নিয়েছি আর ভাইয়া সংসারের হাল ধরেছেন । বাবা না থাকায় ভাইবোনেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে পাত্রস্থ করতে চাচ্ছেন । আমিও তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে এক সময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম।
নববিবাহিতা আমি স্বামীর সাথে সুখে স্বাচ্ছন্দে ঘর করতে লাগলাম । আমার স্বামী একজন প্রবাসী এবং সেই সুবাদে আমি নিজেও প্রবাসে চলে এসেছি । এরই মধ্যে আমাদের সংসারে এক পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। এক সময়ে প্রায় এগারো বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে আমরা স্বপরিবারে দেশে ফিরে আসলাম । দেশে এসে অনেক চেষ্টা করেও দেশের মাটিতে আমার স্বামী কোন প্রকার ব্যবসা বাণিজ্য এগুতে পারলেন না । বরং বিদেশ হতে যত জমানো টাকা সব দেশের ব্যবসাতে লস করে আমরা তখন নিঃস্ব প্রায় । এক পর্যায়ে সংসারের কথা ভেবে আমার স্বামী আবার বিদেশ ফিরে গেলেন । মাঝে মাঝে তিনি দেশে আসেন, কিন্তু উনার মধ্যে আমার প্রতি কোন আকর্ষণ দেখতে পাই না, বরং উনার মাঝে খুঁজে পাই বেশ কিছু পরিবর্তন ।

হঠাৎ করে একদিন আমার ড্রাইভার জানালো আমার স্বামীর পরকীয়ার কথা । সব কিছু শুনে তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো । আমি তখন উন্মাদ প্রায়, স্বামীর কাছে জিজ্ঞাসা করলে সে প্রথম অস্বীকার এবং পরে স্বীকার করেন । সত্যি আমি কখনো ভাবিনি আমার জীবনেও এমন দিন আসবে । তাহলে কী এত দিনের সব টাকা পয়সা ব্যবসার নাম করে সেই মহিলার পিছনেই ভাঙলেন আমার স্বামী ? আমি আমার স্বামীর মধ্যে কোন প্রকার অনুশোচনা দেখতে পাইনা বরং যে কোন উছিলায় আমার স্বামী তখন উঠতে বসতে আমায় শারীরিক নির্যাতন করে। আমি দু’চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম ।
একদিন আমার বড় ভাই সব শুনে বললেন- স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে দিতে কিন্তু, আমি আমার দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে মামলা হতে বিরত থাকি।
নিজের জীবন তো শেষ, সন্তানের জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হই । এদিকে বাসায় কারণে অকারণে ঝগড়া – মারপিট চলতে থাকে । আমার মনে হয় আমি নিজেকে শেষ করে দিলেই কেবল এই নরক যন্ত্রনা হতে পরিত্রান পাবো।
প্রবাসে থাকা অবস্থায় স্বশুর বাড়ির কাছেই জায়গা কিনে একটা তিনতলা বাড়ি করেছিলাম, সেই বাড়ির দলিল দস্তাবেজ ছিল আমার নামেই l যখন সব কিছু অন্ধকার দেখতে লাগলাম । এখানে কোন উপায় না পেয়ে একদিন সেই বাড়িটা বিক্রি করে আবার ফিরে গেলাম প্রবাসে । এখন আমরা আগের চেয়ে অনেক অনেক ভালো আছি । ছেলে মেয়েও অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু আমি আমার অতীত ভুলতে পারিনি, পারিনি ভুলতে স্বামীর অত্যাচার অবিচারের কথাও ।
পৃথিবীতে আবেগ এর স্থান সব থেকে বেশি সে কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই । সেই আবেগকে আঁকড়ে ধরতে যেয়ে আমরা জীবনে বড় বড় ভুল করে থাকি । সংসার জগৎটি জীবনের একটি বড় ধাপ । এই জগতের ব্যাপারে বেশির ভাগ নারীই ভুল করে বসে তার জীবন সঙ্গীকে পছন্দ করতে যেয়ে । আর সেকারণেই কখনো কখনো অনেক নারীই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় । কিন্তু জীবন অনেক সুন্দর, আত্মহত্যা এই নরক যন্ত্রণার সমাধান নয় । এই নরক যন্ত্রনা থেকে বেরিয়ে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার নামই জীবন ।
সারা ফেরদৌস
কবি ও কথা সাহিত্যিক
ঢাকা, বাংলাদেশ।