জানিনা বিয়েতে সত্যি সত্যি ই প্রজাপতি ঋষি উপস্থিত হন কি না কিংবা অগ্নিদেব স্বয়ং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সাক্ষী দেন কি না। কিন্তু প্রায় দশ বছর বিবাহিত জীবন কাটিয়ে মৌ এর এবার মনে হচ্ছে আর কারো বিয়েতে তেঁনারা আসুন বা নাই আসুন তার – তুর্যর বিয়েতে স্বয়ং প্রজাপতি ঋষি ই গাঁটছড়া খানি বেঁধেছিলেন।না হলে এতোদিনে ঢিলে হয়ে যেতো। উফ্ কি একখানা বিয়েই না হয়েছে তার।এম.এ পাশ করতে না করতেই বাবা আর জেঠু মিলে সটান এক পাত্র এনে হাজির করলো। ইউনিভার্সিটির চত্বর থেকেই সোজা ছাদনাতলায়।তা তখন ও বেশ মনে লাড্ডুই ফুটেছিল।কারণ তখন ও তো জানতো না বিয়ের হ্যাপা খানা।এখন হাড়ে হাড়ে বুঝেছে বিয়ে হলো একটা সম্পূর্ণ বেয়াড়া ধরনের বিপরীত চরিত্রের মানুষ কে বিশেষ ভাবে বহন করা।
প্রথম গোল বাঁধলো হানিমুনে গিয়ে ই। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তুর্যর একমাত্র বিলাসিতার বস্তুটি হলো বডিস্প্রে। সাজসজ্জার সময় ওই বস্তুটি না হলে তার সাজপোশাক সম্পূর্ণতার চরম শিখর টি স্পর্শ করতে পারে না।সজ্জাসম্পর্কীয় আর সবকিছু ই এখনও সেই আটপৌরের ঘেরাটোপে ই বন্দী আছে।আর মৌ ঠিক এই জায়গাটিতে ই একখানা চরম ভুল করে বসে। নবলব্ধ তার সংসার টিতে এই বডিস্প্রের মাহাত্ম্য খানি তখনও তেমন করে জানা হয়নি।তাই লাগেজে প্রয়োজনীয় আর সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে নিলে ও ওই বডি স্প্রে লাগেজ বাহিত হয় না।আর যখন হোটেলে পৌঁছে তুর্য স্নানের পর রেডি হতে গিয়ে ই প্রথম সঙ্গীহারা হওয়ার কথা টি প্রথম টের পেলো, তখন তুর্যর মুখদর্শন করেই মৌ বুঝতে পেরে গেছিল যে আসন্ন হানিমুন তাদের কেমন কাটতে চলেছে।আর ব্যগের সবকিছু হাতড়ে যখন তুর্য এই সত্য আবিষ্কার করলো যে আর সবকিছু ই ঠিকঠাক আনা হয়েছে শুধু তার জিনিসটা ই আনা হয়নি,তখন যারপর নাই ব্যথিত হয়েছিল। মন টা ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
গোটা ট্যুর টাই সে”বিসর্জনের কার্তিক”সেজে রইলো। প্রথম প্রথম মৌ এর ও খারাপ লেগেছিল। এমনকি সে নিজেই একটা কিনে দেবে এমন ও বলেছিল। এমন কিছু দুষ্প্রাপ্য মহার্ঘ্য বস্তু ওটা নয়। কিন্তু না তুর্য আর কিনতে রাজি হয়নি। উপরন্তু যে ভুল তার মা কোনো দিন ও করে নি, সেই ভুল মৌ কি করে করলো,এই মোক্ষম বুঝ টা সারাক্ষণ ই বুঝিয়ে গেছে। তবে মৌ এর ও মেজাজ কিছু কম নয়। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলে ও পরে খুব বিরক্ত হয় এবং ঠিক করে ই ফেলে যে আর এর সাথে সে থাকবে না।বাড়ি ফিরে ই সোজা বাপের বাড়ি। তবে তেমন টা আর কোনদিন ও ঠিক হচ্ছে না। আর এমন বহুঘটনা দিনের পর দিন এই দশ বছর ধরে ঘটেই চলেছে। যদিও মৌ এর বক্তব্য সব দোষ ই তুর্য (সত্যতা বিচার্য)।
তবে হ্যাঁ,এই দশ বছরের বিবাহিত জীবনের বাঁকে বাঁকে, মোড়ে মোড়ে মৌ আর তুর্যর মান অভিমান, ঝগড়া,কথাবন্ধের ইতিহাস। আর বহুবার ই মৌ এর বাপের বাড়ি যাওয়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সে পূজার কেনাকাটা ই হোক কি মেয়ের স্কুলের ভর্তি ই হোক। কারন যাই হোক ফলাফল এক। তবে সে সব ঝগড়া কখনো ই এক কি দুদিনের বেশি টেঁকে নি।মৌ মুখভার করেছে, তুর্য চুপচাপ থেকেছে।তারপর সন্ধ্যায় তুর্য,মৌ এর জন্য গরম গরম সিঙ্গাড়া আর রসগোল্লা এনেছে। রাতে হৈ হৈ করে বিরিয়ানি খেয়েছে।এই হলো পরিণতি। এখন তো গুলগুটি ও বুঝে গেছে। তুর্যর মা বাবা তো বটেই।
এরমধ্যেই গুলগুটি পড়াশোনা ও করে, সবকিছু ই চলে।প্রাপ্তি টা ওর ই হয়। বিরিয়ানি খাওয়া। আর তেমন হলে এক দু দিনের জন্য মামাবাড়ি…..হুররে…
আজ আবার মৌ-তুর্যের দশম বিবাহ বার্ষিকী।মৌ এর এই খানে একটা ব্যপার আছে।ওর দাবি প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে নাকি তুর্য নেহাতই অবিবেচক ভাবে উদাসীন অবহেলা ভরে দিনটা এক কথায় বরবাদ করেছিল।গিফ্ট তো দূরের কথা একটা গোলাপ ও মৌ কে দেয় নি।ইভেন,”উইশ”ও করে নি। উফ্,ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় মৌ এর। কিভাবে পারলো তুর্য! যদিও সেদিন ওরা”রব নে বনা দি জোড়ি”দেখতে গেছিলো তারপর রাতে রেস্টুরেন্টে ডিনার করে ফিরেছিল। শুধু ওই গিফটের ব্যাপারটাই যা মাথায় আসেনি। আর ওই খানটাতেই সব অভিযোগ মৌ এর।তাই পরবর্তী নয় বছর ধরে মৌ এর অভিমান আর অভিযোগ এর সম্মুখীন হতে হচ্ছে তুর্য কে।সব খোঁটা নীরবে মুখ বুজে সহ্য করে ও একদিন এর জন্য ও কিন্তু বলেনি,”এই যে ম্যাডাম,এই যে অফিস ম্যানেজ করে যে প্রতিবছর এই আজকের দিনটা ছুটি নিতে ভুলি না,কই একবারও তো বলেন না?”।
যাই হোক আজ সারাদিন বাড়িতে লোকজন। মৌ এর মা, বাবা আর দাদু ও এসেছেন।গুলগুটির খুব মজা। রাতে সবাই মিলে বাইরে ডিনার… অবশ্য ই তার জন্য” বিরিয়ানি”।
কিন্তু তুর্য কই? সেই সকাল থেকেই জলখাবার খেয়ে ই উধাও। যথারীতি মৌ এর মাথাগরম। এমন দিনে ও বরটা বাড়ি নেই। অবশেষে সেই দুপুরে খাওয়ার আগে বাড়ি ফিরলো তুর্য।হাতে একটা অপূর্ব পার্লসের সেট। দারুন–সবাই তুর্যর পছন্দ দেখে অবাক। তুর্য একবার আড়চোখে বৌ এর মুখে চোখ বুলিয়ে নিলো।না! ঠোঁটের কোণে হাসি আর চোখে লজ্জা লজ্জা ভাব। তার মানে…..। আসলে, এবার তুর্য অনেক আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করেছে।এই দশমবারে সে”ভালো স্বামীত্বের”পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে ই। প্রথম বারের সব ভুলগুলো করে শুধরে নেবে।
সন্ধ্যায় সক্কলে রেডি।গুলগুটি তো সব্বার আগে। হঠাৎ সব আনন্দ কে নস্যাৎ করে মৌ এর অভিমানী শব্দ ভেসে আসে,”কোনো আক্কেল আছে?এমন ভাঙা জিনিস কেউ কেনে?কোনো দিন কিছু কেনাকাটা করে নি তো।তাই জানে না। আমার জন্য কিছু কিনতে ওর ইচ্ছে ই করে না, দায় সারা গোছের কাজ করেছে ….. ইত্যাদি,ইত্যাদি….মৌ এর বাক্যবাণ ত্বরিৎগতিতে ধেয়ে এসে তুর্যর হৃদপিন্ডকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। অত্যন্ত রুক্ষ, শুষ্ক সে সে সব শব্দ।হায়! কোথায় সেই লাবণ্য,কমণীয়তা,সে শুধু তুর্য বিয়ের দিন ই দেখেছিলো। তবে তুর্য মহারাজ ও মেজাজে কিছু কম জান না।
আর ওই “দায়সারা,””কেনার ইচ্ছা ছিল না”এই সব কথাগুলো তাকে আহত করেছিলো।সে সত্যিই খুব ভালোবেসে,যত্ন করে ই কিনেছিলো। কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেলো! অতঃপর তুর্য ও দুদ্দাড়িয়ে,ক্ষিপ্ত হয়ে এসে, কোনো কিছু না দেখে ই,না জিজ্ঞেস করেই বলে ওঠে,”দাও ছুঁড়ে ফেলে দাও, আমার কোনো জিনিস ই তো তোমার ভালো লাগে না। আর কোনদিন ও কিচ্ছু দেবো না।এই শিক্ষা হয়েছে আমার।মৌ ও ওই ভাবে কথাগুলো বলে ফেলে ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত হচ্ছিলো, কিন্তু ঠিক সেই সময়েই তুর্যর এই সকল কথা আহত করে।মৌ ও ততক্ষণে,”কোনো কিছু না দেখে কাজ করো কেন?এই দেখো জয়েন্ট এর জায়গায় ভাঙা আছে। এতখানি দাম দিয়ে এমন জিনিস তোমার মত মানুষ ই কেনে।
“কিন্তু তুর্য ততক্ষণে আর কিছু দেখা বা শোনার পরিস্থিতিতে নেই। অতঃপর আরও কয়েক দফা তপ্তবাক্য বিনিময়ের পর মৌ তুর্যের হাতে উপহার ফিরিয়ে দিয়ে দুম্ করে”ডিক্লিয়ার”করে বসে”তোমরা যাও,আমি আর যাবো না”। চোখে অবিশ্রান্ত জলের ধারা।সত্যি তার ও খুব কষ্ট হয়েছে। ব্যস,গুলগুটির মুখ চুপসে যায়। আহা, তবে তার বি…রি….য়া….নি!মেয়ের মেজাজ দেখে মৌ এর মাও বিরক্ত আর লজ্জিত দুই ই হন।মৌ এর দাদু তুর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে,”দাদুভাই ধৈর্যং ধরম্”। আমার দিদিভাই কে ওমনি ওমনি সামলে ফেলবে তাই কি হয়!!”দাদুর কথায় হেসে ফেলে। তুর্যর মা আর মৌ এর মা দুজন মিলে ঠিক ঠাক করে সেট টা, খুব বেশি কিছু না, তবে সামান্য কিছু ডিফেক্ট ছিল। তারপর, তুর্যর হাত এই সেটা পরে মৌ রানীর মানভঞ্জন হয়। অতঃপর সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে ভোঁ ভোঁ।
হঠাৎ সবাই কে অবাক করে দিয়ে টেবিলে এত্তো বড়ো একটা কেক। দাদু মিটিমিটি হাসছেন। আর কেকের উপরে লেখা—
“শুভ বিবাহ বার্ষিকী
To sweet couple
দূর্ধর্ষ দুশমন”
নাম টা দেখে ই সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। ওরা উঠে এসে প্রণাম করে দাদু কে। ওদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেন এভাবেই ভালো থাকিস্ তোরা। আর সাতজন্ম ধরে এমনি ভাবে ই ঝগড়া করে একসাথে থাকিস্।”আরেকবার সবাই মিলে হৈ হৈ করে বলে ওঠে,”সা….ত….জ….ন্ম।”দাদু বলে,”থাকবে থাকবে।”
রাতের বেলায় তুর্য,”কি হারটা তবে আবার ফেরত নিয়ে নিই। ওটা তো ভাঙা, তোমার তো পছন্দ ই হয় নি। উঃ!কি মেজাজ,লেডি দূর্বাসা”চোখ পাকিয়ে মৌ,”আবার আবার শুরু করেছো”তারপর মিষ্টি হেসে বলে,”আমার ওই ভাঙা হার ই ভালো।”তারপর তুর্যর আর ও কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলে,”বেশ করবো ঝগড়া করবো, মারামারি করবো, একশো বার করবো, হাজার বার করবো…।তুই যে আমার”দূর্ধর্ষ দুশমন”। সারাজীবনের,সাতজন্মের,জন্মান্তরের।”