শাশ্বত মন্ডল
(ভারত)
আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলার নববর্ষ। পয়লা বৈশাখ বলতেই যেটা মনে পড়ে সেটা হল সকালবেলায় গঙ্গাস্নান থেকে শুরু করে সন্ধেবেলা দোকানে দোকানে হালখাতা, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজন এর সাথে দেখাসাক্ষাৎ ইত্যাদি। আর যেটা থাকে সেটা হল আর পাঁচটা বাঙালী উৎসব এর মতনই নানারকম খাবার।
ভোজনরসিক বাঙালীর নববর্ষ বলে কথা আর তাতে খাবার থাকবেনা তাই কি হয়। বাড়িতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এইসব ই চিন্তা করছিল ঋষভ। বাড়ির খাবার এর চেয়েও তার প্রিয় খাবার ছিল হালখাতা করা দোকানে দেওয়া মিষ্টিগুলো বিশেষ করে লাড্ডু। ঋষভ মফস্বল এর ছেলে তাই ওর কাছে পয়লা বৈশাখ মানে কোন সান্ধ্যকালীন বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয় বরং দোকানে হালখাতা করা আর লাড্ডু খাওয়া।
তবে কলকাতায় আসার পর এই পয়লা বৈশাখ এর একটা অন্য তাৎপর্যও হয়েছে তার জীবনে। সাতবছর আগে এই দিন এই তো সে অস্মিতা কে তার মনের কথা বলেছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সে যখন কলকাতায় আসে, কলেজে প্রথম দিন অস্মিতা কে দেখেই তার ভালো লেগে যায়, যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।
কিন্তু ওরকম প্রানবন্ত অস্মিতা কে দেখে মফস্বলের লাজুক ঋষভএর কথা বলতে একটু তো ইতস্তত হতই।তার এই সমস্যার সমাধান অস্মিতা নিজেই করেছিল যেদিন ও নিজেই ঋষভএর সাথে কথা বলেছিল। তারপর ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়।অবশেষে পয়লা বৈশাখ এর দিন ঋষভ সাহস করে তার মনের কথা বলে দেয় তাকে, তার পর অস্মিতার সে কি রাগ, ঋষভ তো প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিল, ভাবছিল এই বুঝি সবশেষ।
কিন্তু পরে যখন সে তার রাগের কারন জানল, খানিকটা স্বস্তি পেল সে। অস্মিতার রাগের কারন ছিল ঋষভ কেন এত দেরী করে বলল। সেদিন বলেছিল, “ গাধা, আর দেরি করলে ওই সিনিয়র জয়দা কে আমি প্রপোজ করে দিতাম”
তার পর থেকে প্রতি বছর এই দিন টা খুব স্পেশাল ভাবে কাটায় ওরা। কিন্তু এবছর আর সে উপায় নেই করোনাদেবীর আশীর্বাদ এ এখন সকলে আমরা গৃহবন্দী।কর্মসূত্রে কলকাতার বাসিন্দা হলেও ঋষভ তাই এখন নিজের বাড়িতেই আছে। কিন্তু তা বলে কি সে অস্মিতার থেকে দূরে থাকবে? মোটেও না! অস্মিতা কে ফোন করেই উইশ করতে হবে তার লাভ অ্যানিভার্সারি।এই সব ভাবতে ভাবতেই সে অস্মিতা কে ফোন করল আর অপেক্ষা করতে লাগল ফোন টা রিসিভ হওয়ার।
ঋষভ : হ্যালো, হ্যাঁ অস্মি? কি করছিস?
ঋষভ- বাহ ভালো তো, আঁক ছবি?…কী? আমি?.. আমি আর কি করব বল, এই তোর কথাই ভাবছি, হাহা
উল্টো দিক থেকে হাসির শব্দ আসে।
ঋষভ- ওহ তুই হাসছিস, হাস হাস। যাকগে ছাড়, বোর হচ্ছিস বল? আমিও রে, এই ২২ দিন ধরে ঘরে বসে।ধুর।তবে একটা ভালো জিনিস হয়েছে, অনেক ভালো রান্না মায়ের থেকে শিখে নিয়েছি হিহি।
আবার হাসির শব্দ আসে ওপাশ থেকে।
ঋষভ- ওই শোন, আজ কেন ফোন করেছি জানিস?…..ওবাবা, জানতাম ভুলে যাবি… সেই প্রতিবছর আমাকেই মনে রাখতে হয়। ধুর…
ক্ষানিক চুপ থেকে ঋষভ আবার বলে, আজ ই তোকে তোকে আমি প্রপোজ করেছিলাম। সেদিন খুব রেগে গিয়েছিলি তুই, হাহা। আজ সকাল থেকে এসবই ভাবছিলাম। সব পুরনো কথা মনে পড়ছে আজ, জানিস কখন তোকে প্রথম ভালো লেগেছিল বল তো, যেদিন কলেজ ফ্রেশারস এ নীল শাড়ি তে তোকে দেখেছিলাম, ওই কি যেন বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। ক্লাসে রোজ সু্যোগ পেলে তোকেই দেখতাম, কথা বলার সাহস হতনা তারপর তুই ই কথা বলতে শুরু করলি, ব্যাস, সেই শুরু হল।তারপর প্রপোজ, প্রেম ডেট এসব। তোর আর একটা জিনিস ও আমার ভালো লাগতো, তোর ছবি আকা। কীকরে পারিস এত ভালো আঁকতে?.
যাই হোক আরও অনেক কিছু আজ মনে পড়ছে, মনে আছে তোর যেদিন আমি তোকে প্রথমবার চুমু খেয়েছিলাম, হিহি কতটা নার্ভাস ছিলাম বল, তারওপর তুই রেগে গিয়ে বললি যে, মাউথওয়াশ না ইউজ করলে মার জুটবে আমার,,হাহাহা। মনে পড়ে যখন তোর মনখারাপ হত তখন তোকে নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম, ময়দান, সরোবর সব জায়গায় যেতাম।
একটানা কথা বলতে বলতে ঋষভ খানিকটা আবেগপ্রবন হয়ে গেল, সে আরও বলল, তোর মনে পড়ে অস্মি এই বছর টা ছাড়া এ একটা বছর আমরা একসাথে এই দিনটা সেলিব্রেট করিনি, যে বছর আমি ব্যাঙ্গালোরে চাকরি পেলাম। জানিস খুব মনখারাপ হত আমার, তাই তো চলে এলাম ট্রান্সফার নিয়ে। তোকে ছেড়ে ওভাবে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু এবছর দেখ এই লকডাউন। হুস।
খানিক থেমে সে বলল, জানিস তোর জায়গা আমার জীবনে কেউই নিতে পারবে না,, আই লাভ………
কথা শেষ হবার আগেই ঋষভএর মা শোভাদেবী ঘরে ঢুকলেন। ছেলে কে ফোন এ কথা বলতে দেখেই তিনি বলে উঠলেন, কী বাবু কার সাথে এত কথা হচ্ছে?
ঋষভ খানিকটা চমকে গেল তার মায়ের এই প্রশ্নে।
“ ওই কিছু না…… এমনি……..” আমতা আমতা করতে লাগল সে, “ কই দেখি” বলে ফোন টা কেড়ে নিলেন শোভা দেবী, ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ঋষভ এর চোখে জল। শোভাদেবী ঋষভএর পাশে বসলেন, বললেন, “ বাবু ২ বছর হয়ে গেল এবার তো সত্যি টা মেনে নে। আর কতদিন অস্মির রেকর্ডইং শুনে কাটাবি।” ঋষভ এর ঠোঁট কাপতে থাকে, ভারি গলায় বলে, “ মা, খুব মিস করি আমি ওকে……” বলতে বলতেও কেঁদে ফেলে সে।
শোভাদেবী তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “বাবু ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট, আর অস্মির চলে যাওয়া তে আমার ও খুবই কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু কি করব, মেনে নিতে হবে তো… এটাই জীবন। “ ঋষভ হাউহাউ করে কাদতে শুরু করে।
শোভাদেবী আরও বলেন যে “ সবসময় ভালো কথা ভাবতে হয় রে, আমি জানি তুই কতটা কষ্ট পাস, কিন্তু তোকে এরকম দেখলে আমার কী ভালোলাগে বল? আমার আর কে আছে বল তুই ছাড়া…….” ঋষভ এটা শুনে খানিকটা শান্ত হয়, তার মা কে জিজ্ঞাসা করে, “ তোমার ও খুব কষ্ট হয়েছিল বল যখন বাবা চলে গেছিল?” শোভাদেবী চোখে জল নিয়েও মৃদু হেসে বললেন, “ খুব, কিন্তু আমি কাদিনি কারন আমি কাদলে তোর বাবা কষ্ট পেতেন যে………..তাই তোকেও বলছি কাদবি না, অস্মি যেখানেই থাকুক,,তুই ভালো থাকলেই ও শান্তি পাবে।” ঋষভ চোখের জল মোছে র বলে “ আমি ও আর কাঁদবনা মা, কাঁদব না।”
শোভাদেবী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “ এই তো গুড বয়, নীচে আয় আমি খাবার বাড়ছি,”. বলে চলে গেলেন শোভাদেবী। ঋষভ তার ফোন থেকে অস্মিতার ছবিটা বের করে বলল “ হ্যাপি অ্যানিভার্সারি অস্মি, আই লাভ ইউ।” বলেই ফোনটা পকেটে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পাশের বাড়ির থেকে গান এর আওয়াজ ভেসে আসছে
“ আবার ফিরে এলে জেগে আছি, পড়িনি ঘুমিয়ে
আবার ফিরে এলে, ভালোবাসায় পুড়েও যাইনি ফুরিয়ে”