দেবী
‘শরীরটা ভালো নেই রে জয়। পায়ের ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছে।ডাক্তার বলেছে টিউমার হয়েছে দুটো হাড়ের মাঝে।আমি ভালো নেই। বিনীতার ওরফে বিনির কথা শুনে ইতস্তত হয়ে জয় বলে উঠল ,‘আচ্ছা আচ্ছা , ডক্টর কি বলেছে? অপারেশন করতে হবে কি?’বিনি ফোনটা হাতে নিয়ে কোনরকমে বলল ,‘না অপারেশন করতে হবে না তবে পায়ে নিক্যাপ লাগিয়ে ঠিকঠাক মতো থাকলে হয়তো টিউমারটা আর বাড়বে না।
ব্যথাটা কম হবে তবে আমি হয়তো আগের মতো হাঁটতে পারব না ,বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেও পারবো না। খুব কষ্ট হচ্ছে রে। ভাবলে যতটা না যন্ত্রণা হচ্ছে তার থেকে বেশি মানসিক কষ্ট হচ্ছে। সব শুনে জয় বলল,‘বুঝলাম… তবে সমস্যা তো হবেই এটা কাটিয়ে উঠতে হবে।আমরা সবাই তোর পাশে আছি।একদম একা ভাববি না।’বিনি কিছুটা ভারী গলায় বলল,‘আমি যাকে পাশে চেয়েছিলাম তার সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। আমার অসুখের কথাটা শুনে সে যেন আরও দূরে চলে গেল।
আমি ভাবতে পারিনি এরকমটা হতে পারে। সত্যি কথাটা বলতে বলতে নিজের গলাটা শুকিয়ে আসছিল বিনির। সৌম্যর সাথে তার ৩ বছরের সম্পর্কের বাঁধনটা কখন ছিঁড়ে গেছে বিনীতা বুঝতেও পারেনি। কি করে সৌম্য তাকে এতটা অবহেলা করতে পারে? শুধু কি তার অসুস্থতা নাকি অন্য অন্য কোনো কারণ। সে যাই হোক আর ওসব ভেবে লাভ নেই। এই কঠিন সময়ে শুধু মা-বাবা ,পরিবার ছাড়া আর কাউকে সে পাশে পায়নি আর বন্ধু বলতে পুরানো কিছু বন্ধু। জয় ওর অনেক ছোটবেলাকার বন্ধু।
একসময় একই পাড়াতে থাকতো। এখন ওরা অন্য কোথাও চলে গেছে তবে বন্ধুত্বটা শেষ হয়ে যায়নি। ওইদিকে জয় কি বলে চলেছে তার দিকে খেয়াল নেই বিনির । সে বলল ,‘আজ ফোনটা রাখি রে জয়। ভালো লাগছে না কিছু আর প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।ওষুধ খেয়েছি তো তাই …’কথা থামিয়ে দিল জয় ,‘ বুঝতে পারছি, ওষুধের সাইড ইফেক্ট ঘুমিয়ে পর। আমি কাল তোকে ফোন করে খবর নেব…গুড নাইট। জয়ের সাথে কথা বলার পর কিছুক্ষণ নিজের মনেই কেঁদেছিল বিনীতা। সৌম্য কি একবার ফোন করতে পারত না ? যে শূণ্যস্থানটা তৈরি করেছে সৌম্য সেটা কি জয়ের সাথে কথা বললে পূরণ করা যায়? এই ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল বিনীতা।
ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভাঙলো বিনীতার।ফোনটা আনমনে তুলতেই জয় বলে উঠলো,‘গুড মর্নিং , ম্যাডাম’,জয় উইশ করাতে বিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও নিজেকে সামলে নিল,‘ মর্নিং বল কি হয়েছে? ’জয় জিজ্ঞাসা করল যে শরীর ভালো আছে কিনা। সত্যি,শরীর যে ভালো নেই সেটা ওর আগেই বোঝা উচিত ছিল। অনেকদিন ধরে ঘরে বসে থাকতে থাকতে আর সে পেরে উঠছে না।
জয় মজার ছলেই বলে ফেলল,‘চল না একদিন গীতাঞ্জলি পার্ক থেকে ঘুরে আসি।তোর বাড়ির সামনেই তো পার্কটা হেঁটে যেতে অসুবিধা হবে না।বিকালবেলা চলে আসিস।আমি অপেক্ষা করবো। কথা শুনে অবাক হলো বিনীতা। জয় কি বুঝতে পারছে না নাকি বুঝতে চাইছি না ওর কষ্টটা। তারপর বললো ,‘আমার পক্ষে সম্ভব নয় রে ওখানে যাওয়া।
তাছাড়া আমি একা বেরোতে পারি না।বেরোনোর সাহস পাই না আর বাড়ি থেকে কেউ ছাড়বেও না। জয় নির্বোধের মত বলে উঠলো,‘ তুই এত ভাবছিস কেন ? তোকে আমি নিয়ে যাব বাড়ি থেকে। হেঁটে না যেতে পারলে তুই গাড়ি করে যাবি…বিনীতা কিন্তু এবার সত্যিই রেগে গেল ,‘তোর কি মনে হয় আমার বাড়িতে গাড়ি আছে নাকি তুই গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যাবি।তোরা কোনদিন মেয়েদের কষ্টটা বুঝবি না। সব ছেলেরা একই রকম হয়। জয় হঠাৎ করে হেসে উঠলো।বিনীত ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,‘ কিরে তুই হাসছিস কেন?
‘বিনি তুই নিজের ফর্মে ফিরে এসেছিস ঠিক আগের মত। শোন আজ বিকালে তোর বাড়ি যাচ্ছি আর কাকিমাকে বলে রাখিস আমরা ঘুরতে যাবো। অনেকদিন পর তোর সাথে দেখা হবে, অনেক গল্প হবে আর তুই চিন্তা করিস না আমি তোকে সাবধানেই নিয়ে যাব। বিনি মনে মনে ভাবল, জয় দেখা করতে আসতেই পারে তবে সে কোথাও যেতে পারবে না। এভাবেই শুরু হলো আজকের দিনটা।
বাড়ির মেইন গেট খোলার আওয়াজে পাড়ার কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠল। বিনীতা বুঝতে পারল জয় এসেছে। এখন প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। এই অসময়ে জয়কে দেখে বেশ অবাক হল না বিনীতার মা। বিনি নাকি আগেই জানিয়েছিল যে জয় আসবে আজ তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না যে জয় বিনিকে দেখতেই এসেছে। জয় চটপট প্রণাম করে বলল,‘কাকিমা বিনির যে শরীর খারাপ সেটা অনেকদিন ধরে শুনছি। নতুন কাজে জয়েন করেছি তো কাজের একটু চাপ আছে তাই দেখা করতে আসতে পারিনি। ও ভালো হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি আপনি চিন্তা করবেন না।
তবে ওর মন ভালো রাখাটা প্রয়োজন। কাল রাতে ওর সাথে কথা হয়েছিল ও একদম ভালো নেই। বিনির মা বললো,‘শুধু ও কেন বাড়ির কেউই ভালো নেই? টিউমারটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপারেশন করাতেও ভয় লাগছে। জয় বুঝতে পারলো ওনার মানসিক অবস্থাটা।
‘কাকিমা বিনি কোথায়? আমি ভাবছিলাম ওকে নিয়ে একবার পার্কে গেলে কেমন হয়।ও বলছিল অনেকদিন বাড়ি থেকে বেরোয় না তাই ভাবলাম আমরা দু’জনে মিলে যদি একটু ঘুরতে যাই। আপনার কোন আপত্তি নেই তো ? না মানে আমি সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলাম আপনাকে…ওর মা হেসে বলল,‘কি আর আপত্তি থাকবে ? ওকি যেতে রাজি হবে ? আমার মনে হয় ও যাবে না। তাও তুমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো।
জয় চেষ্টা করবে বলেই তো এসেছে। জয় বিনির সাথে দেখা করল।বিনি কেমন একটা হয়ে গেছে প্রচন্ড রোগা আর অদ্ভুত প্রাণহীন। জয় অনেক কষ্ট করে বিনিকে বোঝালো যে তার কিছুই হয়নি। সে চেষ্টা করলে আবার হাঁটতে পারবে। আর সৌম্য… জীবন থেকে এই নামটা যদি মুছে ফেলতে পারে তবে ও আরো ভালোভাবে এই কর্কট রোগের সাথে লড়াই করতে পারবে।
‘শোন বিনি বিপদের সময় আসল মানুষকে চেনা যায়। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই সৌম্যর থেকে আরো ভালো কাউকে পেয়ে যাবি…ভালো না হোক এমন কাউকে পাবি যে তোকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে না’
কতটা থামিয়ে দিয়ে বিনি বলে ওঠে,‘ওর ছেড়ে যাওয়ার কারণটা আমি এখনো ঠিক জানিনা। আর এই অন্ধকারে থাকার কষ্টটা কেউ কোনদিনও বুঝবে না? যেমন তুই বুঝবি না আমার পায়ের যন্ত্রণাটা। যদি বুঝতি তাহলে আজ এত জোড় করতি না আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
জয় কথাটা শুনে একটুও অবাক হল না। সে একটু দৃঢ়স্বরে বলল,‘তুই আমাকে কি বোঝানোর চেষ্টা করছিস বলতো?ক্যান্সার কি সেটা আমি অনেক ছোটবেলায় প্রত্যক্ষ করেছিলাম। মাত্র সাত বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি। তুই ঠিকই বলেছিস যন্ত্রণা কি জিনিস আমি জানি না। তাও বলবো নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ কর। আর চল বাইরে থেকে ঘুরে আসি একটু ভালো লাগবে। কাকিমা কিন্তু পারমিশন দিয়েছে আমাকে। বিনি অবাক,‘মা পারমিশন দিয়ে দিয়েছে? বাঃ ভালো ,আমাকে সাহায্য না করলে আমি কিন্তু যেতে পারবো না। আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবি তো। জয় হেসে বলল,‘একদম, তুই আর আমি হাত ধরে হাঁটবো।
দু’জন দু’জনের কাঁধে হাত রেখে অনেকটা পথ হেঁটে গেল তারা। হাঁটতে গিয়ে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিল বিনি তবুও আজ তার হাঁটতে ইচ্ছে করছে। এইভাবে হাতে হাত রেখে একজনের উপর নির্ভর করে সে শেষ কবে হেঁটেছে মনে করতে পারে না। একটা পাথরের উপর গিয়ে বসল বিনি। আসে পাশে কোনো বসার জায়গাই খালি নেই। জয় ঠিক ওর পায়ের সামনের মাটিতেই হাঁটু গেড়ে বসলো।
বিনীতা অনেকবার বারণ করল তবুও জয় শুনলো না। প্রেমিকার পায়ের সামনে বসলে নাকি প্রেমিকার চোখ দু’টোকে অনুভব করা যায়। এটাই বলেছিল জয় তবে বিনীতা তো আর ওর প্রেমিকা নয়। নিরিবিলিতে পার্কে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে বিনি জিজ্ঞাসা করল,‘এবার তোর খবর বল। এখনো কি টিউশন করেই দিন কাটাচ্ছিস? জয় বলল,‘ না ,ম্যাডাম চাকরি পেয়েছি। আর একটা ২ কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকি আমি আর বাবা। ভাবছি এবার বিয়েটা করেই ফেলব। তাই এত কিছু….
বিনি অবাক হয়ে বলল,‘এতকিছু মানে? এখন অব্দি ক’টা মেয়ে দেখলি তুই? একজনকেও কেউ পছন্দ হলো না…
‘ধুর, আমার আর পছন্দের কি আছে…সবাইতো আমাকেই রিজেক্ট করে দিয়ে চলে যাচ্ছে ।কালো,লম্বা,রোগা এই ছেলেটাকে কোনদিনই কোন মেয়ে প্রাধান্য দেয়নি। তুই তো সবই জানিস। জয়ের কথা শুনতে শুনতে বিনীতা হেসেই যাচ্ছিল তারপর বলল,‘না রে ,জয় তোর মনটা খুবই ভালো। দেখিস খুব ভালো বউ হবে তোর। জয় বিনীতার হাতের উপর হাত রেখে বলল,‘বেশি কিছু চাই না রে তোর মত একজন হলেই হবে। তুই আমাকে একবার চান্স দিয়ে দেখতে পারিস।
তোকে খারাপ রাখবো না। বিনীতা জয়ের হাতের উপর থেকে হাত সরিয়ে না নিয়ে বলল সে বেশি দিন নাও বাঁচতে পারে যদি টিউমারটা ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার হয়ে যায় যদি। দুই হাড়ের মাঝে টিউমারটা তাকে প্রতিনিয়ত ব্যথা দিয়ে যায়। জয় বললো,’সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন মানুষ কত কঠিন রোগকে হারিয়ে দিয়ে বেঁচে আছে জানিস। বাঁচার ইচ্ছে থাকাটা খুব দরকার আর না হলে অপারেশন করিয়ে নিবি । আমি তোকে আগেই বললাম না আমার বেশি কিছু চাইনা শুধু একটা কোল চাই যেখানে মাথা দিয়ে একটা শান্তির ঘুম দিতে পারব। মনের শান্তিটা খুব প্রয়োজন জানিস তো বিনি।
বিনীতারও ভালো লাগছিল জয়কে,‘আমারও একটা কাঁধ চাই। বিশ্বাস করে মাথা রাখতে চাই কাঁধে কিন্তু ভয় হয়… যদি তুইও কোনদিন আমাকে সৌম্যের মত ছেড়ে চলে যাস…’জয় মাটিতে বসেই বিনীতার কোলে মাথা রাখলো,‘ভালোবাসাকে ছেড়ে কেউ যায় না রে পাগলী যদি সে ভালোবাসায় স্নেহ থাকে, শ্রদ্ধা থাকে, শান্তি থাকে। যে ভালোবাসাকে অবহেলা করে সে কোনদিনই ভালোবাসতে পারেনি। সৌম্য তোকে ভালোবাসলে অন্তত পালিয়ে যাবার কারণটা তোকে জানিয়ে যেত।
এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারতো না। পড়ন্ত বিকেলের অস্তমিত আলো এসে ভালোবাসাকে জমিয়ে রাখতে চায়। পার্কের জনঘনত্বের মধ্যেই বিনীতার আঙুল বাধ্য প্রেমিকার মত জয়ের চুলের ওপর বিলি কেটে দেয়। জয়ও বিনীতার পা ছুঁয়ে আদর করে সযত্নে। পায়ের ব্যথাটা যেন একটু হলেও কম মনে হয় বিনীতার। সে অনুভব করে তার মনের মতো শরীরও যেন কর্কট মুক্ত আজ।