৭ মার্চ রোববার, ১৯৭১ সাল। লাখো মানুষের দ্রোহে শামিল ছিলেন হতদরিদ্র ‘মনোয়ারা বিবি’।
‘মনোয়ারা বিবি’র পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়, ৮ মার্চ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র মারফত। সেখানে উল্লেখ আছে, বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হবার পূর্বে তিনি সেদিন গান গেয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন জনতাকে। তথ্য – শ্রদ্ধেয় জাফর ওয়াজেদ (মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট)।
একটি দেশের মানুষ দীর্ঘকালের অন্যায্য আচরণ, লুঠ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য, আলোচিত, মহা কিংবদন্তী, স্বাধীন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার উদাত্ত আহবান শুনতেই সেদিন উপস্থিত ছিলেন নব ইতিহাসের সূচনা লগ্নে।
একাত্তরের ৭ই মার্চের তীব্র দ্রোহের উজ্জ্বলতম ইতিহাসের একটি অংশ ধারন করছে এই ছবিটি। দেশ স্বাধীন হলে এই নারীর কি এমন হতো, অথবা স্বাধীনতা পরবর্তীতে কি হয়েছে আমরা জানিনা।
তবে, নিশ্চিতভাবেই বঙ্গভবন অথবা গণভবনে দাওয়াত প্রাপ্তদের কাতারে তিনি বা তাঁর মতো অগণিতজনরা নেই। এটুকু অবশ্যই বলতে পারি, একটি ভালো পোশাক আর তিনবেলা দু’মুঠো খাবার আর রাতে ঘুমাবার জন্য একটা ঘর, এসবই ছিল তাঁর কাছে ‘স্বাধীনতা’র সমার্থক।
আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা নেই, কিন্তু তবুও তিনি হাজির হয়েছিলেন রেসকোর্সের ময়দানে। কেন? কোন যাদুকরের আহবানে, কেমন ছিল সেই ডাক? যেজন্য তিনি পঙ্গু হয়েও রেসকোর্সের মাঠে গেলেন। তাঁর মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমরা ২০২১ সালে অনেক বাক্য কপচাতে পারি কিন্তু নিশ্চিতভাবেই উপসংহার টানতে পারিনা।
যে বাঁশটি ধরে সেদিন মনোয়ারা বিবি দাঁড়িয়েছিলেন, সেটার মাথায় কালো পতাকা দৃশ্যমান। প্রতিবাদে তিনি শামিল হয়েছিলেন ধনী-নির্ধন বৈষম্য ঘুচিয়ে। সেদিনের লক্ষ্য ছিল সবার একটিই ‘স্বাধীনতা ও স্বাধিকার’।
আমরা কি এই মানুষটির স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি? রাষ্ট্র কি নিশ্চিত করতে পেরেছে সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক সব অধিকার?
পঞ্চাশ বছর যাবত, যে যার যার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় এতই বুঁদ হয়ে আছি যে, মানুষে মানুষে মহাসঙ্গমের লেশমাত্র নেই। সবাই যার যার খাঁচায় বাঁদর নৃত্য করছি।
‘গৌরব ও বেদনার একাত্তর’ তখনই সফল হবে, সার্থক হবে, যখন আমরা প্রকৃতভাবেই একটি মানবিক ও জন কল্যানকর রাষ্ট্র-সমাজ গঠন করতে সক্ষম হবো। আজ যেন আমরা ভুলে না যাই, ‘বাংলা’ নামের দেশটি দাঁড়িয়ে আছে ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্তস্নাত অবস্থায়।
স্বাধীনতা এত সস্তা নয়, নয় এত ঠুনকো। ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্ত মিশে আছে বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমিনে। যে জমিনে পা রাখছেন, খেলছেন, আত্মঅহমে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন, সেই জমিনের মতো পবিত্র কোন ভূখণ্ড এই পৃথিবীতে নাই।
মনোয়ারা বিবিরা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যান, যদিও তাঁরাই ইতিহাসের নির্মাতা। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি তাঁদের প্রতি।
ফটোগ্রাফার: শ্রদ্ধেয় Jalaluddin Haider
সৌজন্যে: গেরিলা৭১ ও বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র (নুরুল)