লাবণ্য কান্তা
সমগ্র পড়ার শুরুটা এমন, কোনো ভূমিকা এবং উৎসর্গ পত্র ব্যতীতই সরাসরি সূচীপত্রে চলে যাওয়া। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে সমগ্র পড়তে নারাজ। তবুও সমগ্রকে সাদরে গ্রহণ করা ব্যতীত নিরুপায় হতে হয়।আজকের এই সমগ্রটিতে রয়েছে বুদ্ধদেব বসুর কাব্যগ্রন্থ ‘ কংকাবতী’ ‘ দময়ন্তী’ ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ ‘ অন্যান্য কবিতা’ উপন্যাস দুটি __’ শোনপাংশু’ এবং ‘ পরিক্রমা’। রয়েছে ‘ গল্পগুচ্ছ’ ‘ প্রবন্ধ’ এবং গ্রন্থ সমালোচনা।
অনেকদিন যাবত কবিতা পড়া হচ্ছিলো না, এতগুলো কবিতা একসাথে পেয়ে শুরু হলো কবিতা দিয়েই। পড়তে পড়তে রাত ঢলতে থাকে একটি কবিতায় গিয়ে একটু থেমে যেতে হলো। বুদ্ধদেব বসু কি আশ্চর্য প্রার্থনা নিবেদন করেছেন সেই কবিতায়, যে কবিতা পাঠের গতি রুদ্ধ করলো তাকে বাইরে আনার চেষ্টা মাত্র।
কবিতাটির শিরোনাম __
”প্রেমিকের প্রার্থনা”
“চুলে তার খেলা করে হেমন্তের বিকালের সোনালি আলোক,
তরল নয়নে তার আলো-ভরা অন্ধকার করে টলমল;
শিশিরের মতো মেয়ে, শিশিরের মতো তার শরীর শীতল,
তুষারের মত শাদা দেহ তার __ প্রদীপের মতো তার চোখ।
__ ঈশ্বর , তাহারে তুমি করো আশীর্বাদ।
কবিতার মতো মেয়ে, সোনালি চুলের রাশি রহস্যে ঘোরালো,
গানের মতন মেয়ে, হাসি-ভরা সারা মুখ, আনন্দ-সৌরভে তার নিঃশ্বাস মদির;
চুলে তার, চোখে তার, মুখে তার উৎসবের আনন্দের আলো।
ঈশ্বর, তাহারে তুমি করো আশীর্বাদ।
পরশে চাহনি তার, দৃষ্টিতে চুম্বন, আর চুম্বনে মরণ;
বাহুতে আনন্দ তার __ অধর, হৃদয়ভরা প্রেমের সুষমা,
সকল মেয়ের প্রেমে এই মেয়ে অপরুপ, রূপে নিরুপমা।
এই মেয়ে! __ আর কেউ জানে না বাসিতে ভালো তাহার মতন ।
___ ঈশ্বর তাহারে তুমি কোরো আশীর্বাদ।
আর আমি হায়, আমি ভালোবাসিয়াছি তার প্রতিটি দেহ-কণা
এত ভালোবাসিয়াছি __ সব তারে বলা যায়, কোথায় সে ভাষা?
তাই ভালোবেসে যাই, ভালোবেসে যাই তারে, তার ভালোবাসা;
তাই তার তরে শুধু অধরের, হৃদয়ের একটি প্রার্থনা __
__ ঈশ্বর তাহারে তুমি কোরো আশীর্বাদ।”
বুদ্ধদেবের কবিতা পরিসরে বেশ বড়। তেমনি এই কবিতাটিও বেশ বড়। কিছু পঙক্তি এই লেখায় তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি।
বাকিটা থেকে গেলো মলাটের ভেতরে। কবিতাটি পড়তে পড়তে আশ্চর্যরকমভাবে কবির আকুলতার গান বেজে গেছে রাতের নির্জনতায়। কী আশ্চর্য শব্দের গঠন, কী বলিষ্ঠ উচ্চারণ যেন ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করতেই হবে এই মেয়েকে। এই মেয়ে আমাকে ভালোবেসেছে, তুমি আর কিছু নাইবা করো তাকে তুমি আশীর্বাদ করো।
এমন আশ্চর্য আরও অনেক কবিতা পড়তে পড়তে বেশ কিছু গ্রন্থ সমালোচনা পড়ার পর এলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ র সমালোচনা। বুদ্ধদেব বসু বলছেন, “ভাদ্র,১৩৩৫ –এর ‘ প্রবাসীতে’ ‘শেষের কবিতা’র প্রথম কিস্তি বেরুতেই জনৈক সমালোচক তার এক ব্যখ্যা করেন। রবীন্দ্রনাথ বর্তমান কালে আধুনিক উচ্চ শিক্ষাভিমানী, অন্তঃসারশূন্য যুবকের যে Type দেখতে পাচ্ছেন, অমিত রায়ের পরিকল্পনায় সেই Typeটিকে মূর্তি দেয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রথম শ্রেণীর কথাশিল্পী বলে এবং প্রকৃ্ত রস সাহিত্যে শুধু Idealist experience –এরই স্থান আছে বলে তিনি বাঁদর গড়তে শিব গড়ে ফেলেছেন।”
এমন সমালোচনার জন্য বুদ্ধদেব বসু যথেষ্ট যুক্তি তুলে ধরেছেন জনৈক সমালোচকের বিরুদ্ধে। ‘শেষের কবিতা’ যে তীব্র সমালোচনার রোষানলে পড়েছিল এই কথা মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর “স্বর্গের কাছাকাছি” গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন। এমন সমালোচনাকে পেছনে ফেলে ‘শেষের কবিতা’ আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ শিক্ষিত বাঙালি এমন নেই যে সে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়েনি। এসব ভাবতে ভাবতে এবং পড়ার গতি আগাতে রাত গভীর থেকে গভীর হলো।
রাত দুটো বাজে, হাত থেকে বুদ্ধদেব সমগ্র ধীরে পড়ে গেছে, চোখের চশমা চোখেই থেকে গেছে, নিদ্রাদেবী ভর করলেন চোখের তারায়। চোখে আলো পড়ছে, ঘরে আলো জ্বলছে, দু’চারটে মশাও আক্রমণ করেছে। হঠাৎ আবার কি কারণে জেগে উঠে চোখ, আবার হাতে বুদ্ধদেব সমগ্র নেয়া।
শেষের কবিতার সব থেকে মোলায়েম এবং যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা বুদ্ধদেবের সমালোচনা পড়তে পড়তে ভোরের আলো ফুটে গেছে। চারদিকে কাকেরা রব তুলেছে, পাখিদের গানে মুখরিত আলোকিত ভোর, দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। তখনো সমসাময়িক সাহিত্যের সমালোচনা পড়া শেষ হয়নি, অথচ একটি আশ্চর্য রাত্রি পেরিয়ে সকাল এলো এবং তখনো বুদ্ধদেব বসুর সমগ্রের ভেতরে মন রয়ে গেছে, সবশেষে আরেকটি রাত এসে ঘিরে ধরেছে।