১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল রফিক, সালাম,বরকতসহ আরো অনেকে।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে লিখেছেন, “প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ”।
আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক আরো লিখেছেন, “ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়।এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই হয়েছিল এবং বাঙালি মুসলমানের সেকুলার জাতীয়তাবোধ এর পেছনে কাজ করেছে।”
তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’।
সেই সমাবেশেই উপস্থিত অনেকেই সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন। এই ঘোষণা থেকেই মূলত নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে বাঙালীর স্বপ্নভঙ্গের সূচনা।
জিন্নাহর মৃত্যুর পর ও ভাষা নিয়ে বিতর্ক চলছিল এবং ১৯৫২ সালের শুরু পর্যন্ত থেমে থেমে আন্দোলন হয়েছে।
তবে এই আন্দোলন ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের রূপ নেয় যখন বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
পূর্ব-বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহ’র কথার পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময়ও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে।
তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে বঞ্চনার অনুভূতি আরও জোরালো হয়ে জেগে ওঠে।
খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে পরদিন থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল। যাতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
পরবর্তিতে ভাসানীর নেতৃত্বে সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সম্প্রদায়ের মানুষজন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো। যা লংঘন করেই সেদিন জন্ম হয়েছিল শহীদ দিবসের।
যদিও এই হত্যাকান্ড মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনকে রোধ করতে পারে নি।এর দুই বছরের বেশি সময় পর পাকিস্তান সংসদে বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর। মূলত মাতৃভাষা নিয়ে এই আন্দোলনেই পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বীজ বপন হয়েছিল আর আমরা পেয়েছি বাংলা,আমাদের মায়ের ভাষা,প্রানের ভাষা।
আজ বিশ্বের ১৯১ টি দেশ আমাদের মাতৃভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে আর বিশ্বাকাশে বাংলা জয়ের প্রতীক লাল সবুজের পতাকা দীপ্ত অহংকারে উড়ছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকল ভাষা-শহীদদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম ।
উম্মে কুলসুম মুন্নি, সাহিত্য সম্পাদক।