স্নিগ্ধা ঘোষ
চোখের সামনে ছটফট করছে তাতানের শরীরটা। যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। তাতানের মা, শিখা দেবী নিজের দু’হাতের মুঠো শক্ত করে বসে আছেন। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছে। ছেলের দিকে তিনি ফিরেও তাকালেন না।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই সতেরো বছর বয়সী শরীরটা নিথর হয়ে গেল। একবার ঝাপসা চোখে ঘড়ির দিকে তাকালেন তিনি। নাহ্, আর দেরি করা ঠিক হবে না। আর এক ঘন্টার মধ্যেই এসে পড়বেন তাতানের বাবা। কাঁপা হাতে পায়েসের বাটি থেকে এক চামচ পায়েস তুলে নিলেন। আর আধ ঘন্টা পর তাদের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে থাকবে তিন পাতার চিঠিটা। শিখা দেবীর লেখা চিঠি। চিঠিটা এরকম –
আমি শিখা ভৌমিক। রসায়নের শিক্ষিকা। আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য এবং আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমি। আমি নিজের হাতে আমার ছেলেকে খুন করেছি। কারণ জানতে চান? তাহলে শুনুন –
আমার তাতান বরাবরই মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে প্রথম দিকেই থাকতো। ওকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল আমার। জানতাম একদিন ও আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। একমাত্র সন্তান আমাদের। কোনো কিছুরই অভাব রাখিনি। চাওয়ার আগেই সব কিছু দিয়েছি ওকে। ছেলেও আমার মা ছাড়া কিছু জানে না। কার সঙ্গে কি কথা হয়েছে, কার সঙ্গে মারামারি হয়েছে, সব কথা বলা চাই। আমিই মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম ওর এতো কথা শুনতে শুনতে।
ওই যে, যেবার বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম বার কোন এক বন্ধুর বাড়িতে পিকনিক করতে গেল, রাতে খাওয়া দাওয়া করে ওখানেই থাকবে, আসবে পরদিন সকালে। ওর বাবা তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। ছেলে সবে ক্লাস এইটে পড়ে। এখনই একা ছাড়া ঠিক নয়। এই সময়ে ছেলেরা বিগড়ে যায়। আমি জেদ ধরলাম, কেন যাবে না? বাকি বন্ধুদের বাবা-মায়েরা তো দিব্যি যেতে দিচ্ছে।
আমরা কেন আটকাবো? আমার ছেলেকে আমি চিনি। ও কোনো খারাপ কাজ করবে না। আমার জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত ওর বাবা হার মানলো। কিন্তু, তার পরদিন ফিরে দুপুরে আমার কাছে শুয়ে সে কি কান্না। ওরা ওখানে মদ খেয়েছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে ছেলের কান্না – “আমাকে ক্ষমা করে দাও মা, আর কোনোদিনও ওসব ছোঁবো না। বাবাকে বোলো না।” আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম, বলবো না ওর বাবাকে। ভাবুন দেখি ছেলের কান্ড। পাগল ছেলে আমার। মাকে সব কথা না বললে দিনই কাটে না।
তারপর ক্লাস নাইনে অরুন্ধতী না কি যেন নাম, সেই মেয়ের সঙ্গে নাকি তাতান সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তাও এসে বলেছে আমাকে। ওই বয়সে একটু আধটু হয় এমন। তার কিছুদিন পরই বাড়ি এসে ছেলের সে কি কান্না, মেয়েটা নাকি বাজে, অনেক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তাই তাতান আর সম্পর্ক রাখেনি। সেদিন সারাদিন ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। বুঝিয়েছি ওকে।
কিছুদিন পর ওর ব্যাগে সিগারেট পেয়েছিলাম। দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল। তাতানকেই সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলাম, ও বলেছিলো ওর কোন এক বন্ধু ওকে কিনে নিয়ে যেতে বলেছে। হ্যাঁ, তাই হবে। ও যে আমাকে কথা দিয়েছে ওসব ছোঁবে না। আমার ছেলে আমাকে মিথ্যা বলতে পারে না। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল, আমার তাতানকে অবিশ্বাস করার জন্য। ও হয়তো বুঝতে পারছিল। তাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা আমি তো তোমার ছেলে, আমি কখনও খারাপ কাজ করতে পারি না।” সোনা ছেলে আমার।
তারপর তো তাতান মাধ্যমিক পাশ করলো। ওর রেজাল্ট দেখে তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। সারা পাড়া, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে মিষ্টি মুখ করিয়েছি। ছেলের আবার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা। তাই তো একটা ভালো কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিলাম। বাড়ি থেকে অবশ্য কিছু দূরে কোচিং সেন্টারটা। ছেলে আমার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।
একদিন ওই কোচিং সেন্টার থেকে ফোন এলো আমার কাছে। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। আমি গেলাম। ওদের স্যার আমাকে বললেন, তাতান আর ওর কয়েকজন বন্ধু মিলে কোচিং সেন্টারের একটা মেয়ের সঙ্গে নাকি অশ্লীলতা করেছে। শুনে তো আমার মাথা গরম হয়ে গেল।
আমি ওনাকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম উনি নিজের চোখে দেখেছেন কি না। না, উনি দেখেননি। মেয়েটি ওনার কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। ব্যস, আবার কি, কথা শুনতে হলো ওনাকেই। উনি নিজের চোখে দেখেননি, আর আমার ছেলের সম্পর্কে এসব কথা! সাহসটা ভাবুন একবার। সোজা বললাম, “দেখুন, আমার ছেলে অত্যন্ত মেধাবী, কোনো রাগ থেকে যে কেউ ওর নামে এসব কথা বলতেই পারে।

তাই বলে আপনি যাচাই না করে বিশ্বাস করে নেবেন? আমার ছেলেকে আমি চিনি। ও কক্ষনো এসব করতে পারে না। আর যদি এই ধরনের কথা প্রমাণ ছাড়া আমার কানে আসে, তাহলে আমি আমার ছেলেকে কোচিং সেন্টার থেকে ছাড়াতে বাধ্য হবো।
আপনাদের কাজ ছেলেদের ভবিষ্যত তৈরী করা, আপনি সেটাই করুন।” বাড়ি এসে ছেলেকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, মেয়েটা খারাপ। তাতানকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। রাজি হয়নি, তাই এসব নাটক। আমি তো তাতানকে বলে দিলাম, ওসব নিয়ে আর না ভেবে পড়ার দিকে মনোযোগ দিতে। যা বলার আমিই স্যারকে বলে এসেছি। তারপর থেকে আর কোনো অভিযোগ আসেনি।
কোচিং সেন্টারের বার্ষিক অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত ন’টা বেজে গিয়েছিল। তাতান ফোন করে বললো আজ রাতটা ওর এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাবে। বন্ধুর বাড়ি কাছেই। বন্ধুর বাবা লোকাল কাউন্সিলর। ভদ্রলোকের নামডাক আছে এলাকায়। তাই আমিও ভাবলাম, ভালো জায়গাতেই আছে ছেলে। আর আপত্তি করিনি। পরদিন সকাল ১০ টার দিকে বাড়ি ফিরলো ছেলে। আবার নিজের পড়াশোনায় ডুবে গেল। সত্যি, ছেলে আমার লাখে একটা।
তারপর দিন খবরের কাগজে একটা বাজে খবর চোখে পড়লো। আমাদের এলাকায় একটা মেয়ে ধর্ষণ হয়েছে। এলাকার বাইরে একটা পোড়ো বাড়িতে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। মেয়েটা তাতানের কোচিং সেন্টারেই পড়ে। সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে মেয়েটা বাড়ি ফেরেনি। তারপর খুঁজতে খুঁজতে কাল রাতে পাওয়া গেছে তার মৃতদেহ। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার ছেলের বয়সী মেয়েটা। কি করে যে মানুষ এতো হিংস্র হতে পারে জানি না। খবরটা তাতানের চোখে পড়তে, দেখলাম ও চুপচাপ হয়ে গেল। মন তো খারাপ হবেই, একসাথে পড়তো, বন্ধু হবে। আমিও আর বেশি কিছু বললাম না ওকে।
কিন্তু, সন্ধ্যায় তাতানের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনলাম ও ফোনে কাউকে বলছে- “ভাই, কাগজে বেরিয়েছে খবরটা। যদি ধরা পরে যাই, কি হবে ভাই? হ্যাঁ, জানি তোর বাবা কাউন্সিলর। ঠিক মিথ্যে প্রমাণ দিয়ে দেবেন যে আমরা দুজন ন’টা থেকে সকাল পর্যন্ত তোর বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু ভাই, আমার খুব ভয় করছে। এরকম হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। মালটাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে ফেঁসে যাবো না তো ভাই?” এই কথাগুলো শুনে আমার মাথা ঘুরিতে শুরু করে দিয়েছিলো। তাই হয়তো অজান্তেই নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল – তাতান!
তাতানের তখন হুঁশ ফিরলো। খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে সামলে ফোন ফেলে দিয়ে আমার কাছে ছুটে এলো। আমি তো তখন ঠিক করে দাঁড়াতেই পারছি না। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তাতান আমাকে ধরে নিয়ে বিছানায় বসালো। কথা যেন হারিয়ে গেছে আমার। অনেক কষ্টে বললাম, “এসব তুই কি বলছিলি? মেয়েটাকে তোরা?”
ও আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বললো, “মা, মা গো, আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমি বুঝতে পারিনি। আমার তো ওকে খুব ভালো লাগতো। ওকে বলেছিলাম। কিন্তু, ও রাজি হলো না।আমি কি করবো মা? আমি তো ওকে আরও একদিন বোঝাতে গিয়েছিলাম। মাথা গরম করে হাত টেনে ফেলেছিলাম। আর ও কিনা স্যারকে গিয়ে বলে দিলো? স্যার আবার তোমাকে বলে দিলো মা।
তখন থেকে কোথা থেকে যেন আমার মাথায় প্রতিশোধের ভূত চেপে গিয়েছিল। ওর বাড়ি ওই পোড়ো বাড়িটার পাশ দিয়েই যেতে হয়। ওর বাবা নেই। তাই বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। এটা জানতাম। আর ওই রাস্তায় লোকজনের যাতায়াত খুব কম সেদিন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কিছু আগে আমি আর সুরজিৎ ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আর ও আসতেই ওকে আমরা দুজন ওই বাড়িটার মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলাম জোর করে। ওকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম বিশ্বাস করো মা। কিন্তু, ও কিছুতেই বুঝছিল না। চিৎকার করছিল। তাই, রাগের মাথায় কি হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। ও মা, আমি তো তোমাকে সব বললাম, এবার আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করে ফেলেছি মা। আর হবে না। এবারের মতো আমাকে বাঁচাও। আমার মাথার ঠিক ছিল না।”
কিন্তু, আমার মাথা ততক্ষণে ঠিক হয়ে গেছে। আমার ছেলে যখন অপরাধ করেছে, তখন তো এই অপরাধের হাত থেকে আমার ছেলেকে আমাকেই রক্ষা করতে হবে। পাগলের মত কেঁদে যাচ্ছে আমার ছেলেটা। আর বলে চলেছে, “ক্ষমা করে দাও আমাকে, শেষ বারের মত।” কি আর করি, মা তো আমি। আলতো হাত ছেলের মাথায় রেখে বললাম, “তুই কিছু চিন্তা করিসনা, কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর মা এখনও বেঁচে আছে।”
আজ স্কুল থেকে ফিরে তাতানের জন্য পায়েস রান্না করলাম। পায়েস খেতে বড়ো ভালোবাসে ছেলে আমার। ও তো দেখে খুব খুশি। দু’চামচ খাওয়ার পরই কষ্টটা শুরু হয় ওর। ল্যাব থেকে আনা পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে ছিলাম ওই বাটিতে। আমি জানি, আমাদের আইন ওকে শাস্তি দিতে পারবে না। হয়তো জানাই যাবে না কাজটা ওরা করেছে। জানা গেলেও কাউন্সিলর হয়তো টাকা খাইয়ে সব চাপা দিয়ে দেবে। তাই নিজের হাতে শাস্তি দিলাম। শাস্তি ওকে পেতেই হতো। কি করেছিল ওই মেয়েটা? যার কারণে ওকে খুন হতে হলো? কিছুই করেনি। তাও লোলুপতার শিকার হতে হয়েছে ওকে। স্কুলে এতদিন মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করছি, কিন্তু নিজের ঘরেই একটা অমানুষ তৈরি হয়েছে, সেটা বুঝিনি। এতদিন পর্যন্ত আমার ছেলেকে আমি আগলে এসেছি। তাই, ওর শাস্তিও আমিই নির্ধারণ করলাম। কিন্তু, আমি আমার ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তাই এই ছেলেকে জন্ম দেওয়ার শাস্তিটাও না হয় আমি নিজেই নিজেকে দিলাম।
ইতি – অমানুষের মা।
ভীষণ অন্তর্নিহিত একটা মানে খুঁজে পেলাম। দারুন।