শাশ্বত মন্ডল
পাশের পার্কে চলা প্রোগ্রাম এর আওয়াজে ঘুম ভাঙলো
ঋতবান এর। হ্যাঁ আজ রাখি পূর্ণিমা, তাই পাশের পার্ক এ ধুমধাম করে রাখিবন্ধন উৎসব পালন হচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় ৯ টা বাজে। “ ওহ শিট” বলেই সে চলে গেল ফ্রেশ হতে, আজ ওর বন্ধুদের সাথে গেট টুগেদার আছে যে। ঋতবান মৈত্র, পেশায় লেখক এবং চিত্রকার। যাদবপুর এ বাস, আদিবাড়ি নব্দ্বীপ এ।
কাজের চাপ এ কোনদিন ই তার বন্ধুদের সাথে দেখা করার সময় হয় না, প্রিয়বন্ধু শুভম তো রীতিমতো বলেই দিয়েছিল, “ ঋত আর আমাদের পাত্তা দেবে না, ও এখন সেলেব, আর আমরা…” কথা শেষ করতে দেয়নি ঋতবান, বলেছিল, “ও কে ডান, এই রাখীপূর্ণিমা তে ছুটি, ওই দিন দেখা করব সবাই, রাজি??” প্রস্তাব শুনে সবাই হইহই করলেও শুভম শান্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “ঋত আর ইউ সিরিয়াস? মানে, ওই দিন ই?” ঋতবান বলেছিল, “ হুম ওই দিন ই, এবার যদি না পারি আর পারবনা”, মৃদু হেসেছিল সে।শুভম বলেছিল, “ ঠিক আছে…টেক কেয়ার ব্রো।”
আজ সেই কথা রাখার দিন তাতে আবার লেট হয়ে গেলে খুব কথা শুনতে হবে, তাই তারাতারি সে রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ল, কিম লি যেতে বড়জোর আধ ঘন্টা লাগবে, আর সে তো নিজেই ড্রাইভ করবে। আজকের চাইনিজ এর ট্রিট তার তরফ থেকেই হবে। গাড়ি বার করতে যাবে এমন সময় তার মা এর ফোন এল,
“হ্যাঁ মা বলো,”
“ হ্যালো ঋত,বলছি পৌঁছে গেছিস,”
“ না মা, সবে বেরলাম, আসলে দেরি হয়ে গেছিল সকালে উঠতে, তুমি খেয়েছ? বাবা কি করছে?
“ তোর বাবার আর কি? ওই নিউজ আর নিউজ”
“ আর তুমি, খাওনি বল?”
কাঁপা গলায় ঋতবানএর মা বললেন, “ কিকরে খাই বল আজ…”
ঋতবান খানিকটা চুপ করে গেল, দিয়ে বলল,” মন খারাপ কোরনা, খেয়ে নিও, আমি রাখছি, ড্রাইভ করতে হবে, ভালো থেকো, রাখলাম”
ফোন টা কেটে দেয় সে। কয়েকবার ঢোক গিলে সে ড্রাইভিং শুরু করে। অতীত কে তাকে পেছনে ফেলে আসতেই হবে,নাহলে সে আর বাঁচতে পারবে না।তাই সব ভাবনা সে ঝেড়ে ফেলে দিল।
যথাসময়েই সে পৌঁছে গেল কিম লি তে, এটা তার ফেভারিট চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। গিয়ে দেখে সবাই উপস্থিত, প্রিয়াঙ্কা, আত্রেয়ী, মনিদীপ এবং তার বেস্টফ্রেন্ড, শুভম। শুভম ছাড়া বাকিরা সবাই কলেজ ফ্রেন্ড, শুভম সেই ছোট্ট থেকে ঋতবান এর সঙ্গী, একসাথে, স্কুল, কলেজ সব ই।
ঋতবান আসতেই শুভম বলে উঠল , “ আসুন আসুন মি. চিত্রকর শেষমেষ তাহলে সময় হল আপনার এই নগন্যদের সাথে দেখা করার জন্য, হাহা”। “ বড্ড ফোচকেমি করছিস তুই “ বলেই কুনুই এ করে শুভম কে আলতো ধাক্কা দিল ঋতবান। আত্রেয়ী বলল, ওই সবাই চল ভেতরে, আমার খুব খিদে পেয়েছে, মনিদীপ বলল, “ মানে এই তো বললি বাড়ি থেকে লুচি ঘুগনি খেয়ে এসছিস, আবার খিদে, বুঝলি ঋত, এর বয়ফ্রেন্ড এর কি অবস্থা হয় বুঝছিস নিশ্চয়ই…একেবারে ফতুর। “ সবাই হো হো করে হেসে উঠলো, এবার প্রিয়াঙ্কা ই বলল চল এবার, “ আমার আবার প্রোগ্রাম আছে দুপুরে, আমাকে বেরতে হবে জলদি।” মণিদীপ আবার বলে, কেন রে আজ কি আবার তোর।” প্রিয়াঙ্কা বলল, “ আরে আমাদের কমপ্লেক্সে এর প্রোগ্রাম, তার জন্যই।” শুভম বলল, “ তো কি এখানেই কথা বলবি,নাকি যাবি ভেতরে?”
সবাই ভেতরে ঢোকে, টেবিল চয়েস করে বসে। শুভম ঋতবান কে জিজ্ঞাসা করে, “ অল গুড?” ঋতবান মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ায়।
এরপর টুকটাক কথাবার্তা চলতে থাকে এবং ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে যায়। হঠাৎ ই মনিদীপ বলে ওঠে, “ বল তোদের কটা করে রাখি হল আজ, আমার তো ভাই অনেক গুলো করেই হয়, নিজের বোন, কাজিন সবাই আছে, তাই আমার পকেট ও আজকে ফাঁকা হয় বেশি, কি ঋত, তোর তো এরকম কোন ব্যাপার নেই, ভালোই আছিস, হাহা….” কথা শেষ হবার আগেই ঋতবান প্রচন্ড রেগে খাবার উল্টে রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়ে চলে যায়, ঘটনা এত টা আকস্মিক যে কেউ তাকে আটকানোর সময় পায় না, সবাই “ ঋত, ঋত,” বলে চিতকার করতে থাকে কিন্তু ঋতবান সেসব না শুনেই চলে যায়। সবাই যখন কি হয়েছে বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়া চাওই করছে তখন ই শুভম বলে ওঠে, “ এটার ই ভয় করছিলাম”।
আত্রেয়ী আর মনিদীপ একসাথে বলে, কিসের ভয় শুভম? শুভম মৃদু হাসে, প্রিয়াঙ্কা বলে ওঠে, “ হোয়াট ইস গোয়িং অন, শুভম, ক্লিয়ার করে বলবি, ঋত ইজ ইওর বেস্টফ্রেন্ড তাও তুই ওকে আটকালি না, ইউ নো সামথিং, প্লিজ টেল আস।” শুভম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” তবে শোন সবাই।”
অনেকদিন আগেকার কথা, আমি আর ঋত তখন ক্লাস ফাইভ এ পড়ি, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল সে, বরাবর ই তার একটা বোনের চাহিদা ছিল, বলত ওকে কেউ ফোঁটা দেয়না, রাখি পড়ায় না, আমরা হাসতাম, কিন্তু ভগবান মনে হয় ওর এই দুঃখ বুঝেছিল, তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের বাড়িতে একটা ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হল, তিন্নি। তখন আর ঋত কে দেখে কে?সারাদিন শুধু তিন্নি আর তিন্নি, আমাদের কে আর পাত্তা দিত না, ঋত ছোট থেকেই আঁকত, তিন্নি কে তার রং পেনসিল, খাতা সব কিছুতেই সমান অধিকার সে দিত। তিন্নির একটা সমস্যা ছিল, তার হার্ট একটু দুর্বল ছিল। ডাক্তার এ বলেছিল বেশি বকাঝকা করা যাবে না, শক পেলে হার্টফেল অবধি হতে পারে, এটা ঋত জানার পর তিন্নি কে কাছছাড়া ই করত না, যদি ওর মা বাবা তিন্নি কে বকত, সে তার, মা বাবা কেই উল্টে কথা শোনাত। এরকম করে পাচ বছর কেটে গেল, আমরা তখন মাধ্যমিক দিয়েছি, তারপর ছুটি কাটাচ্ছি, এমন একদিন এ ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ঋতর সাথে কিছু ছেলের খুব ঝামেলা হয়, আমি তাকে কোনরকমে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসি, সে আমার কথা মানলেও রাগ কমায়নি। অন্যদিকে বেচারি তিন্নি, সে ঋতর সমস্ত ড্রয়িং খাতা নিয়ে আঁকিবুকি করছে, বেচারি জানতো না এর ফল কি হবে। এরপর ঋত ঘরে যায়, নিজের সাধের ড্রয়িং খাতা তে তিন্নির কাজকর্ম দেখে খুব রেগে যায়, মাথা তো আগেই গরম ছিল তাই সব রোষ সে ওই বাচ্চা তিন্নির ওপর উগড়ে দেয়। এত চিৎকার সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারায় সে। প্রথমে না বুঝলেও পরে ঋত বুঝতে পারে সে কি ভুল করেছে, তারাতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওকে কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে তখন,তিন্নি চিরতরে হারিয়ে যায় সবার থেকে।
এতটা শোনার পর জলভরা চোখে আত্রেয়ী জিজ্ঞেস করে, “ তার পর কি হল?”
শুভম বলে,” তারপর ঋত অনেক ভেঙে গেছিল, ধীরে ধীরে ও ঠিক হয় কিন্তু ভাইফোঁটা বা রাখির দিন ওর ব্রেকডাউন হয়, তাই আজ যখন ও প্ল্যান করে আমি বলেছিলাম ওকে, ও বলল এবার ওকে অতীত ভুলতেই হবে….. কিন্তু”
মনিদীপ এতক্ষণ পর বলল,” আমার জন্যই হল, আমার খুব খারাপ লাগছে, শুভম তুই জানিস কোথায় যেতে পারে ও”
শুভম হেসে বলল “ কোথায় আবার,বাড়ি গিয়ে কাদবে ও আর কি…”
মনিদীপ বলল, “ চল ওর বাড়ি যাই, আই হ্যাভ টু সে সরি।”
শুভম বলল, “ চল”
ওরা সবাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, কিছুদুর যেতেই দেখে রাস্তায় খুব ভিড়, জটলা হচ্ছে একটা।
শুভম এক পথচারী কে গাড়ি থেকেই জিজ্ঞেস করল,” দাদা কি হয়েছে এখানে?”
পথচারী বলল,” আরে দাদা, অ্যাক্সিডেন্ট, একটা মারুতি কে একটা লরি সামনে থেকে ধাক্কা মেরেছে, লরির ড্রাইভার কে আটকে রেখেছি, মারুতির লোকটা গেছে।” কথা শুনে চার বন্ধু জলদি গাড়ি থেকে নেমে আসে, ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখে, ঋতবান এর গাড়ি টা দুমড়ে মুচড়ে গেছে, আর তার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, ঋতবান এর রক্তাক্ত প্রানহীন দেহ, রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে রাস্তায় পড়ছে গাড়ির জানালা থেকে।