আমি তখন মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নিয়মিত ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষার পরই ইউনিভার্সিটি জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। হল থেকে খুব বেশি বের হতাম না। বোরিং লাগলে মাঝে মাঝে বিকাল বেলা হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম হাকিমের চায়ের দোকানে। ওখানে চা খেয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার পরপরই হলে চলে আসতাম।
পরীক্ষার পর চাকুরি হোক বা না হোক, মা আমার বিবাহ ঠিক করে রেখেছে। আমিও সেই মেয়েকে দেখেছি, কথা বলেছি। ওর নাম নীলিমা। রূপশ্রী কলাবতী মেয়ে। ওড়না উড়ে তার করতোয়ার বক্ষ ছুঁয়ে আসা উতল বাতাসে। হেমন্ত জোছনায় চোখ আলো করে রাখে। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বাজে জল তরঙ্গের মতো। কী এক রহস্যময় জগৎ উন্মোচিত হবে, সেই ভাবনায় সেই অপেক্ষায় কখনও কখনও পরীক্ষার পড়া ভুল ভাবে মস্তিষ্কে ধরা দিত। মনে রাখতে পারতাম না। ‘মোর ভাবনারে একি হাওয়া লাগল দোলে মন দোলে অকারণ হরষে’।
সেদিন দুপুরে রুমে টেবিলে বসে পড়ছিলাম সোফোক্লিসের ইডিপাস। জটিল কমপ্লেক্সে মনটা যখন উথালপাতাল হচ্ছিল, ঠিক তখন ডাকপিওন একটি পত্র দরজার নীচে দিয়ে ফেলে রেখে যায়। মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ও তাই মাঝে মাঝে আমার কুশল জানতে চেয়ে চিঠি লেখে। ভেবেছিলাম নীলিমার চিঠি হবে।
কিন্তু না। এটি নীলিমার চিঠি ছিল না। অন্য আর একজনের চিঠি। চিঠির নীচে একটি মেয়ের নাম লেখা আছে — অপরাজিতা।
আমি অপরাজিতা নামে কোনো মেয়েকে চিনি না। কে এই অপরাজিতা? চিঠিতে লিখেছে —
প্রিয়জনেষু আনিস,
একটু অবাকই হচ্ছো অপরাজিতা মেয়েটি আবার কে? আমাকে তুমি দেখেছ অনেক। যদি কখনও আবার দেখ, ঠিকই চিনতে পারবে আমাকে। আমি কে, এই কথা বলব না তোমাকে। তুমি আমাকে জানলে আমার প্রতি তোমার আর আগ্রহ থাকবে না।
তোমাকে আমার কবে ভালো লেগেছিল জানো?
একদিন তুমি গাঢ় নীল রঙের জিন্স প্যান্টের সাথে হালকা নীল রঙের টি-সার্ট পরেছিলে। পায়ে ছিল সাদা কেডস্। তোমার মোছ সদ্য গজিয়ে ওঠা দূর্বা ঘাসের মতো সতেজ, চুল এলভিস প্রিসলীর মতো পিছনে ব্রাশ করে আঁচড়ান। স্নানের পর ললাটে নেমে আসে কেশদাম ৷ চোখ স্বপ্নচ্ছটা। কখনও মেঘলা আকাশের তারার মতো মণিদীপ। তুমি মাধুকর। ছেলে মানুষও দেখতে এত টান টান হয়। আমি বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছিলাম । তোমাকে ভালো লাগা ওখান থেকেই। হৃদয়ে ভাঙন তখন থেকেই শুরু । কিন্তু প্রপোজ করিনি কখনও। কেন করিনি সে অনেক কারণ, অনেক ভাঙচুরের কথা।
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।
তোমার মতো আর কোনও ছেলে আমি দেখিনি। রূপে গুণে, গানে আর প্রাণের প্লাবনে তুমি যে অনন্য। তুমি স্বপ্নে দেখা রাজকুমার।
তোমার জন্য আমার মনের মধ্যে তৈরি হয় এক গভীর মায়াবোধ, কীসের যেন একটা অভাবও অনুভব করি। তোমাকে আমার করে কী পাওয়া হবে এই জীবনে? সারাক্ষণ মন কেমন করে। এক ধরনের ভারী বিষণ্ণতা বুক চেপে ধরে আছে ।
বড়ো অসময়ে আমি তোমাকে এই কথাটি বললাম। যখন তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ফিরে আসার কোনো পথ কি তোমার খোলা আছে? নাকি রুদ্ধ তোমার সকল দুয়ার?
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — অপরাজিতা।
অপরাজিতা নামে কোনো মেয়ের সাথে কোনো দিন আমার পরিচয় ছিল না। তার নামও কোনও দিন শুনিনি। নিশ্চয়ই ছদ্মনাম দিয়ে কেউ এই চিঠিটি লিখেছে। যে আমাকে খুব কাছে থেকে জানে। আমার হলের রুম নং ও তার জানা আছে। কিন্তু কে এই মেয়ে? হাতের লেখাটিও চিনতে পারছি না। একটু দুশ্চিন্তাও করতে থাকি। সামনে আমার শুভ বিবাহ। একজন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে আর কিছুদিন পর হাতে মেহেদি পরবে। কাঁচা হলুদ দেবে তার গায়ে। কপালে টিপ পরবে। খোপায় পরবে শুভ্র সন্ধ্যামালতী ফুল।
রাতে টেবিলে বসে যখন পড়ছিলাম, তখন শরীর মদির হয়ে চোখে ঘুম নেমে আসে। শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসে না। চেয়ে থাকি নিমগ্ন হয়ে। দূরে অনেক দূরে বন ঝাড়ে দেখতে পাই অজস্র অপরাজিতা ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলো বেদনায় নীল। আমি জানি, এদের আয়ু খুব ক্ষণকালের। কে-ই বা ছুঁইবে তাদের। অনাদরে ওরা ঝরে যায় ।
একদিন দুপুরে ডাইনিং রুম থেকে খেয়ে এসে রবি ঠাকুরের কড়ি ও কোমল কবিতার বইটি বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে পড়ছিলাম। পরের দিন রবীন্দ্র সাহিত্য পরীক্ষা। পাশের জানালাটা খোলা ছিল। চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। দেখছিলাম দূরে অনন্ত আকাশের নীল। মনে হচ্ছিল জলেশ্বরী তলার আকাশ দেখছি আমি। যেন ”শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল। / আমার নিখিল / তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল। নাহি জানি, কেহ নাহি জানে–”
আমি জানি — নীলিমা আমার। নীলিমা আমার হবে।
রুমের দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। কড়ি ও কোমল বিছানার উপর রেখে দরজাটা যেয়ে খুলে দেই। দেখি — ডাকপিয়ন চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকেও অপরাজিতার চিঠি।
পরম কল্যাণীয়,
তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? এই সময়ে তোমাকে বিরক্ত করা আমার ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে তোমার সাথে। অথচ এক সময় কত কথা তোমার সাথে বলতে পারতাম। আজ যখন ক্রমে অনেক দূর চলে যাচ্ছ, তখন মনে হয় — তোমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করি। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলি তোমার কঠিন কোমল বুকে। আমার নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় যে ! কোথাও কোনও নন্দন কানন থেকে যদি তুমি একটি চাঁপা ফুল এনে আমায় দিতে, তবে নিঃশ্বাস নিতাম প্রাণ ভরে।
আমার পরম সৌভাগ্য যে তোমাকে আমি চেয়েছিলাম, আর আমার নিয়তি যে তোমাকে আমি কোনও দিন পাব না। তোমার জীবনময় আমি থাকব না, কিন্তু তোমার জীবনভর আমার অদৃশ্য ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকবে। আমার খুব কান্না পায়, কষ্ট হয়, হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে টান লাগে। দুঃখের মাধুরীতে আমাকে শুধু সিক্তই করলে। আমাকে কাছে নেবার কোনও দায় নিলে না। কাঁদিয়েই রাখবে কেবল জনমভর।
তোমাকে আমার জীবনের শেষ অব্দি পর্যন্ত মনে থাকবে। শুধু একটু আফসোস রয়ে গেল তোমার সাথে জলেশ্বরী তলায় তোমাদের বাড়ির আম্রকাননে দাঁড়িয়ে একটা সকাল দেখা হলো না, কাটাতে পারলাম না শোয়ার ঘরে একটি নিঝুম দুপুর, দক্ষিণের বারান্দায় একটা কমলা রঙের বিকেল, আর ছাদে পাটিতে বসে উপভোগ করতে পারলাম না একটি জ্যোৎস্নার রাত।
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — অপরাজিতা।
পরীক্ষার কয়েকটি দিন বাকী ছিল। অনেকটা মন খারাপের ভিতরেই পরীক্ষা শেষ করি। হঠাৎ আনন্দময় ভাবনার ভিতর অজ্ঞাত কোন্ এক মেয়ে মনের উপর একটু বিষণ্ণতার ছায়া ফেলল। ভুলে যাই। মনের উপর জোর রাখলাম, ভাবলাম, এইসব কিছু না। এইসব মিছে মায়া। অন্তরের ভিতর এইসব ঠাঁই দিয়ে আসন্ন শুভক্ষণগুলোকে অসুখকর করা ঠিক হবে না।
যেদিন পরীক্ষা শেষ হয়, সেদিন রুমে এসে দেখি দরজার নিচে দিয়ে পিওন দুটো চিঠি ফেলে রেখে গেছে। একটি চিঠি নীলিমার। আর একটি চিঠি অপরাজিতার। আমি নীলিমার চিঠিখানি প্রথম পড়ি।
প্রিয়তম,
পরীক্ষার শেষ হওয়ার পর দেরি না করে তাড়াতাড়ি চলে আসিও। বাঁধ ভাঙা আবেগে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সময়ে অসময়েই তোমার কথা আমার মনে পড়ে। দিন যত এগিয়ে আসছে, তত আমার শরীর মন কাঁপছে। ভাবি বসে বসে — কী সুন্দর দিন, কী মধুময় রাত হৃদয় পথগামি।
সকাল থেকেই এখানে আজ বৃষ্টি হচ্ছে । দমকা হাওয়ায় মাতিয়ে উঠেছে বৃক্ষরাজি। একটি ছাতা মাথায় দিয়ে দুজন করোতায়া নদীর পারে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আমাকে তুমি বৃষ্টি দাও। ঝুমঝুম করে আমার সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে দাও।
তুমি এসো। চূর্ণ করে দাও আমার অপেক্ষা।কিছুতেই কাজে মন বসে না। তুমি আমাকে তোমার ঘরে তুলে নিয়ে বাজাও বর্ষার মল্লারের সুর।
ভালো থেক তুমি প্রতিদিন সারাক্ষণ।
— তোমার নীলিমা।
এরপরে পড়লাম অপরাজিতার চিঠিটি।

কল্যাণীয়েষু,
আমি জানি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিনই তুমি চলে যাচ্ছ। তোমাদের বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক হয়ে আছে। তোমার এই আসন্ন শুভক্ষণে আজ আর আমি কোনও অমঙ্গলের কথা লিখব না। তোমার এই শুভদিনে আমি শুধু তোমার মঙ্গল প্রার্থনাই করব।
কটা দিন ধরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল তোমাকে অমন করে চিঠি লেখার। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে আমন্ত্রণ করব — বুড়িগঙ্গার পারে যেয়ে দুজন দেখা করব। ওখানে নদীর তীরে কোথাও ঘাসের ওপর বসব—তুমি আর আমি। তখন জলে বিরাজ করবে শুভ্র শান্তি। অন্ধকারে তীরের বৃক্ষ গুল্ম হয়ে উঠবে নিবিড়। অস্তমিত সূর্যের আবছায়ায় মুখ তুলে তাকিয়ে দেখব তোমাকে। লাল আভায় চিক চিক করবে আমার চোখের জল। যদি তোমারও কান্না পায়, যদি তোমারও চোখের জল ঝরে পড়ে আমার ললাটের উপর। তাহলে মরেও শান্তি পাব। কিন্তু তা হলো না। ভয়ও করল যদি তুমি না আসো। আমি নিজেই নিজেকে বারণ করলাম।
হয়ত আর চিঠি লিখব না। একা থাকা কী হবে? কেউ না কেউ আসবে জীবনে। তাকে নিয়েই হবে সংসার। সংসার কর্মের ভিতর তোমাকে যেন ভুলে থাকতে পারি। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার শেষ কটি চরণ দিয়ে এই চিঠিখানা শেষ করছি —
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়, ওগো বন্ধু বিদায়।
— অপরাজিতা।
মনটা কেমন যেন লাগছিল। বাড়িতে আসার আগের দিন এমনই একদিন বুড়িগঙ্গার পারে একাকী চলে যাই। কোথাও নির্জন কূল নেই। নদীতে কত নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার। ওদের আসা যাওয়ার ভেঁপু’র শব্দ। তীরে জনারণ্য। নেই কোথাও বনঝোপ। কোথাও কোনও বন অন্তরালে অপরাজিতা ফুটে নেই।
আমি বাড়িতে চলে যাই। এক ফাগুন দিনে আমার বিয়ের তারিখ হয়।
বিয়ের দুই দিন আগের কথা। সেদিন ঘরে আমি একাই ছিলাম। অনেক রাত্রি হয়েছে। ঘুম আসছিল না চোখে। অপরাজিতার চিঠি তিনটি ব্যাগে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিঠি তিনটির কথা মনে হলো। মনটা কেমন হুহু করে উঠল। একটি সিগারেট ধরাই। দরজার খিরকি খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে একটি তারাও নেই । কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হাতের সিগারেটের পোড়া অর্ধেকটা উঠোনে ফেলে দিয়ে রুমে চলে আসি। টেবিলের উপর ল্যাম্পটি মিটমিট করে জ্বলছিল। ব্যাগের তলা থেকে চিঠি তিনটা বের করে ল্যাম্পের আলোয় আবার পড়তে থাকি। কবে কখন একটি মেয়ে এমন করে আমায় ভালো বেসেছিল, ভেবে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।
দুইদিন পর বিয়ের সানাই বেজে উঠবে। ভাবলাম– অমঙ্গলের এই অভিজ্ঞান কেন ঘরে রাখব? চিঠি তিনটি তাই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করি। এবং ছে্ঁড়া টুকরাগুলি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেই। অন্ধকারে সে টুকরোগুলো দমকা বাতাসে উড়ে কোথায় ধূলোবালিতে মিশে হারিয়ে গেল।
প্রায় এগারো বছর পরে একদিন অপরাজিতার একটি চিঠি পাই। অপরাজিতা লিখেছে —
বন্ধু আমার,
এই শহরে তুমি থাকো। আমিও থাকি। তোমার কুশল আমি সব জানি। তোমাকে দেখিও মাঝে মাঝে। কী সুন্দর পরীর মতো বউ তোমার। বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দূর থেকে তোমার সব সুখ আমি দেখি।
আমার কথা কী তোমার একবারও মনে পড়ে না? অবশ্য আমাকে তুমি মনে রেখো — এই দায় তোমাকে আমি কখনও দেইনি। তোমার উপর থেকে আমার ভালোবাসা একটুও যায়নি। আজও তোমাকে খুব ভালোবাসি।
যে মেয়েটি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, তাকে একটিবারও দেখবার সাধ হয় না? আমাকে না দেখেই তুমি মরে যাবে? এমন অতৃপ্তি তুমি রেখ না। যদি আমাকে দেখবার ইচ্ছে হয় তাহলে দেখতে এসো। কেবিন নং ৫০৭, পঞ্চম তলা, পিজি হাসপাতাল, ঢাকা।
— অপরাজিতা।
দুইদিন পরই একদিন সকাল এগারোটার দিকে আমি পিজি হাসপাতালে চলে যাই। ৫০৭ নং কেবিনের দরজায় নক করি। কেউ খুলছে না। একজন নার্স এগিয়ে আসে। উনি বলছিলেন – ওনার তো আজ অপারেশন হচ্ছে । ওটি নং ৩ এর সামনে চলে যান। ওখানে ওনার স্বজনেরা আছেন। আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করি — কী হয়েছে ওনার? কিসের অপারেশন হচ্ছে।
— যকৃতে ক্যানসার। সম্ভবত শরীরের সারা রক্তে তা ছড়িয়ে গেছে।
আমি ৩ নং অপারেশন থিয়েটারের সামনে চলে যাই। ওটির সামনে বেশ কয়েকজন নারী পুরুষকে দেখতে পেলাম। কেউ আমাকে চেনে না। একজন লোককে দেখলাম সে একটি ছয় সাত বছরের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটি কাঁদছেে। বুঝতে পারলাম মেয়েটি অপরাজিতার মেয়ে। আর লোকটি অপরাজিতার স্বামী। ওনার চোখে মুখে চরম উদ্বিগ্নতার ছাপ। আরও যারা আছে, তারাও সবাই চিন্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ণ। কেউ কেউ অশ্রু সিক্ত।
আমি অনাহুতের মতো একটু দূরে কোরিডরে দাঁড়িয়ে থাকি। আধা ঘণ্টা পরে অপারেশন থিয়েটার থেকে কেউ একজন এসে জানায় — রোগিণী মারা গেছে। তারও কিছুক্ষণ পরে স্ট্রেচারে করে সাদা চাদরে ঢেকে মৃত রোগিণীকে ওটি থেকে বের করে আনে। কোরিডরে আত্মজনরা সবাই স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদা কাপড় সরিয়ে সবাই তার মুখখানি দেখছে। আমিও নিঃশব্দে স্ট্রেচারের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, দেখি অপরাজিতার মুখ।
কোরিডর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসি। পিছনে বাচ্চা মেয়েটির ক্রন্দনধ্বনি হাসপাতালের কংক্রিটের দেয়ালে বিদীর্ণ হচ্ছিল। শব্দহীন আত্মস্বরে বলছিলাম — অপরাজিতা, এত কাছে ছিলে তুমি। এত তোমায় দেখেছি। এত ভালো বেসেছিলে তুমি। আমি তা বুঝতে পারিনি। তুমি চোখ বন্ধ করে আছ, দেখলাম তোমার আর্তিময় আঁখিপাতের মায়া।
জীৎ তোমারই হলো। আমিই হেরে গেলাম। বাকী জীবন আফসোস করে কাটাতে হবে। ওপারে তুমি ভালো থেকো অপরাজিতা। রেস্ট ইন পিস।