উম্মে কুলসুম মুন্নি
বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। জানালার গ্লাস বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। সেদিকে অপলক চেয়ে আছে রুপা আর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অজানা কত প্রশ্ন। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পার করে মধ্য বয়সে পা দিয়েছে সে। চাওয়া না-পাওয়ার কষ্টগুলোকে ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় আছে।
হঠাৎ করেই যেন বদলে গেল তার জীবন নদীর বাক।
এই তো সেদিন, অসুস্থ চাচীকে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে করিডোরে দাড়িয়েছিল,হঠাৎই হন্তদন্ত হয়ে কেউ একজন এসে তার সাথে ধাক্কা খেল। ধাক্কা সামলে তার দিকে তাকাতেই সে লজ্জাবনত মস্তকে বলল,সরি আসলে আমার বাবার অবস্হা খুব খারাপ,তাই ডাক্তার খুজছিলাম ।
রুপা ঠিক আছে বলে সেখান থেকে চলে গেল।
পরদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে রুপা আবার হাসপাতালে গেল, সেখানে চাচীর অপারেশন হয়েছে ।
রুপা চাচীকে দেখে কেবিনের বাইরে রোগীর স্বজনদের বসার জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে আছে,কিছুটা অন্যমনস্ক।
হঠাৎ করেই কেউ একজন এসে বলল,শুনুন, সে অবাক হয়ে তাকালো কিন্ত চিনতে পারলো না,তবু্ও বলল,জ্বী বলুন ।
তখন সে অনেক চেনা ভাব নিয়ে বলল,আমাকে চিনতে পারেননি, গতকাল যার সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন।
ওহহ আচ্ছা, আমি চিনতে পারিনি বলে রুপা আবার চুপ হয়ে গেল।
আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি, বলেই রুপার উত্তরের অপেক্ষা না করে তার পাশে বসে পড়ল।
আপনার নামটা জানতে পারি ?
জ্বী,রুপা
আর আমি সজল,প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি,
মিরপুরে থাকি, আপনি ?
রুপা কিছুটা বিব্রত হয়ে জবাব দিল আমি ও প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করি,মিরপুরেই থাকি ।
সজল কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল,আমাদের মধ্যে তো দারুণ মিল,
রুপা বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাতেই সে একটু লজ্জা পেল ।
এবার সজল আবার বলে উঠল যদি কিছু মনে না করেন আপনার ফোন নম্বরটা কি পেতে পারি ? রুপা কিছু বলার আগেই সে আবার বলল,না মানে এখানে তো আমাদের দু’জনেরই রোগী আছে,তাই জরুরি প্রয়োজনে যেন কেউ কার ও খোঁজ নিতে পারি সে জন্য বলছিলাম ।
রুপা কিছুক্ষণ ভেবে ফোন নাম্বারটা দিল,সজল নাম্বারটা দেখল তারপর আজকে আসি বলে উঠে চলে গেল। রুপা তার চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইল।
এরপর রুপা ও উঠে পড়ল বাসায় যাওয়ার জন্য ।
জ্যাম এর জন্য বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেল।
কোন রকম ফ্রেশ হয়ে সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়লো আর হাসপাতালের ঘটনা মনে করতে লাগলো কিন্ত সারাদিনের ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছিল তখনই ফোনটা বেজে উঠল, ধরতেই ওপাশ থেকে অচেনা কন্ঠ বলে উঠল, শুভ সকাল,কেমন আছেন ?
রুপা বিরক্ত হয়ে বলল,সরি রং নাম্বার, সাথে সাথেই ওপাশ থেকে বলল,প্লিজ রাখবেন না,আমি সজল,
এবার রুপা লজ্জা পেল, নাম্বারটা তো সেই দিয়েছিল,আর সজলের টাও নিয়েছিল কিন্তু রাতে বাসায় ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ায় সেটার কথা মনে ছিল না। এবার সে বলল,শুভ সকাল, ভালো আছি ।
আপনি ?
আপনি তো আমাকে চিনতেই পারেননি,কিভাবে ভালো থাকি,সজলের একথা শুনে রুপা কিছু একটা বলতে যাবে ওমনি তাকে থামিয়ে দিয়ে সজল বলল,আজ নিশ্চয়ই দেখা হচ্ছে !
রুপা বুঝতে না পেরে বলল,কেন বলুন তো ?
বাহ্ রে,আমাদের হাসপাতালের ডিউটি আছে না, বলে সজল হাসতে লাগলো।
রুপা বলল,আচ্ছা অফিসের দেরি হয়ে যাবে,পরে কথা হবে, বাই ।
সন্ধ্যায় হাসপাতালের গেইট এ নেমে রিক্সা ভাড়া দিচ্ছে তখন রুপা দেখল কেউ একজন হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে, কাছে আসতে সেও হাসি মুখে সজলকে অভ্যর্থনা জানালো। এরপর দু’জন একসাথে ভিতরে গিয়ে যার যার রুগীর কেবিনে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর রুপা রুম থেকে বের হয়ে তাদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে বসলো। এর একটু পর সজল ও সেখানে আসলো, দু’জনে অনেকক্ষণ নানা কথায় সময় পার করলো,ভিজিটিং আওয়ার শেষে একসাথে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল ।
এভাবে প্রায় পনেরো দিন একটানা প্রতিদিন সন্ধ্যায় দেখা হওয়া,গল্প করা,ক্যান্টিনে বসে চা খাওয়া,একসাথে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া,সেই সাথে প্রতি সকালে শুভেচ্ছা বিনিময়ে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
একদিন রুপার চাচী এবং সজলের বাবা দু’জনেই সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে গেলেন আর নিয়মিত দেখা,আড্ডা খুনসুটির মাঝে তারা বন্ধুত্বের সীমা পেরিয়ে কখন যে দু’জনের এত কাছে চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি,এখন মনে হয় কেউ কাউকে ছাড়া একমূহুর্ত থাকতে পারবে না,কাজের ব্যস্ততায় দেখা না হলে,কথা না হলে অস্থির হয়ে উঠে দু’জনেই ,অভিমান জেকে বসে মনের গহীনে, নিঃশ্বাসে আর অনুভবের ছোঁয়ায় দুলে তারা থাকে দু’জনের খুব কাছাকাছি। আকাশ প্রমান বিশ্বাস নিয়ে দু’জন দু’জনের পাশে থাকার সংকল্পে অবিচল।
আজ তিনবছর পূর্ন হল,সীমাহীন স্বপ্ন গুলোকে এক করে তারা সাজিয়েছে তাদের নতুন পৃথিবী ।
বাইরে হঠাৎ বৃষ্টির ধারা দেখে রুপার মনে হতে লাগলো,সজল যেন তার জীবনে এসেছিল একপশলা বৃষ্টি হয়ে,যে নিমিষেই তার জীবনের সব দুঃখ কষ্ট গুলোকে ধুয়ে নিয়ে তাকে ভাসিয়েছে সুখ আর আনন্দের বন্যায় ।
ঘুমন্ত সজলের পৌরুষদীপ্ত মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে সে ভাবছে সেদিনের সেই অচেনা মানুষটাই আজ তার সবচেয়ে কাছের মানুষ,তার বেচেঁ থাকার অবলম্বন,তার সুখ স্বপ্ন।